নৈরিৎ ইমুর কবিতা


মাগফেরাতের ফুল

রঙিন মুখোশ, গানের ছত্র থেকে
তুলতে চাইলে তুলে নিতে পারো সুর;
আগুনের মতো উত্তাপ বুনে শেষে—
ঝলসে নিয়েছো নিজের আসল মুখ!

বোধ হয় কোথাও যাচ্ছিলাম— এই মীনদেশ, সরিসৃপ অঞ্চল ছেড়ে; আদিম গুহার গন্ধ পেরিয়ে, পুঁতে রাখা গুপ্তধনের উপর রাস্তা বানিয়ে, হেঁটে হেঁটে বহুদূর কোথাও। একা ভ্রমণের কালে মন, মুকুরের মতো হয়ে যায়। সেখানে দৃশ্যের পর দৃশ্য। নিজের সাথে কথায় প্ররোচিত কোন হাওয়া ঘুরে ঘুরে সঙ্গ দেয়৷ ফলে নির্মিত ঘরের বাইরে মানুষের নিরুদ্দেশের গল্প, মৃত্যু সংবাদ, শোকার্ত চিৎকার সব যেনো একবেলা আস্ত কিছু গিলে তিনশ বছর ঘুমিয়ে থাকা সাপের মতো হঠাৎ সামান্য নড়ে চড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। যে ঘুম নিতান্ত আলস্যের পর নেমে আসে আর আড়ালে চলে যাওয়া সূর্যের কারণে যেভাবে চারপাশ তিমিরাচ্ছন্ন হয়, ক্রমে সেভাবে ঘিরে থাকে।

তারা ঝলমল রাত ভেঙে জাগে চাঁদ
চাঁদের গুহায় কবর হয়েছে কার?
ঝাপসা চোখের দৃষ্টি ছাড়িয়ে দূরে
অদেখা আরশ কাঁপলো শব্দ করে।

আবছা হয়ে আসে মুকুর। আবার কোন দৈব আলোর ছটা ফিরিয়ে আনে একটা কয়লাপোড়া কালিভরা হাড়ির মধ্যে বাসিভাত, সিদ্ধ শালগম, নুনের শূন্য দানি। মানুষ বহুভাবে যেতে পারে, মেঘস্বতন্ত্র গুরুগম্ভীর স্বর অনুসরণ করে তারাও পৌঁছে যায় আজাজিলের বাগানবাড়িতে; কুৎসা করে, রটনা রটায়, জিহ্বায় স্বাদ পায় দ্রাক্ষারসের— ফলে তারা কিছুটা মদ্যপ হয়ে অস্তিত্ব সংকটের এক পর্যায়ে আবিষ্কার করে এই পঞ্চইন্দ্রিয় ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।

পেশোয়াজ দোলে পলকা বাতাস লেগে
দুলে ওঠে সাথে পরজন্মের কথা;
জর্জর তবু আলোর ঝিল্লি ঢাকা
খুঁজতে চাইছো এমন আইভি লতা!

ক্ষুদ্রতম দিনে নিজেকে ক্ষুদ্র লাগে আরও। অমর ফুলের মতো ঠোঁট গোল করা শীত নামে। বেধের ভেতর যেনো পয়মন্ত হলো আখেরি লোকের ভাষা। বুঝি না কিছুই তার। কীর্তিনাশার শেষে আধছেঁড়া কাগজ হয়ে বাতাসে ফড়ফড়াই। গুটিয়ে গিয়েছি, যেনো দানবীয় লরির সাথে ধাক্কা লেগেছে হালকা যান। ওলানের সামান্য উত্তাপও পান করে কেউ, মুণ্ডমালার প্রেমে পড়ে। সেও জানে, ছোঁয়াচে রোগের টক— বাঘের শিকার করা হরিণের কাঁচা মাংসের মতো স্বাদু।

উলকি আঁকানো শরীর নিভিয়ে দিয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছো ওফাতনামার পাশে,
ওফাতের পর অর্গল ভেঙে গিয়ে—
মুখোমুখি হলে নিজেই নিজের সাথে!

যেনো হ্রেষা ধ্বনি বরফগলার গল্প, লাল চঞ্চুর তলে ঘুমিয়ে গিয়েছে। এই রঙ্গভার কাঁধে বইবে না কেউ, উপাধিবিহীন কোন তারার সাজে নগ্ন হবে আমাদের তাম্রবর্ণ অঙ্গ। জায়নামাজের মতো বিছিয়ে আছে সবুজ ঘাস— উর্বর ভূমির উপর, কয়েকটা অক্ষর কতটুকু আর হাতুড়ি পিটানোর কাজে লাগে!

নির্জন হলো আখড়াবাড়ির পথ
বুকের ভিতর হারমোনিয়াম কাঁদে;
সুরের আগুনে পুড়ে হলো সব ছাই—
ছড়িয়ে পড়লো মাগফেরাতের ফুল।

সিঁদুর রাঙানো শিবলিঙ্গের মতো উজ্জ্বল হয়েছি নির্জন জিনের দেশে। জমিও পুরনো ব্যথার কথা স্মরণে দেয়। কাদা লেপন করে কোন মেহেদী রাঙা হাত নতুন করেছে পোড়ামেটেঘর, মেঝে ও দেয়াল। কোথায় এমন সরোবর, পাদপদ্মকে সম্বল করে জেগে থাকা? নাকফুল খুঁইয়ে ফেলা কিশোরীর স্নান, বাঁশির ফুঁয়ের সাথে শৃঙ্গভাঙা কতো কালোঘুম উড়ে গেলো। শালতরুবনে অত্যোজ্জ্বল পঙতির সাথে গেঁয়ো হাওয়া খুলে ফেললো সমস্ত ভাঁজ। পাখির উষ্ণ ডিম ছুঁয়ে মনে পড়ে ধুলা ঝেড়ে শপথবাক্য পাঠ, বুকের তলানিতে বিশ্বাসঘাতকের ঘা মেরে বাঁক পাওয়া গেলো নগর ও গরাদ, তবু খোঁপা খুলতে চায় না কেউ —

ক্লিভেজে ট্যাটু

ক্লিভেজে কি ট্যাটু আঁকতে চেয়েছো তুমি?

তোমার রুমাল আজ— শঙ্খচিলের ডানা,
শরীর হয়েছে শবনম
ট্যাটু কি মাঠেঘাটে মেঘের ছায়া?
হাওয়ার মাতন
থেকে খসে যাওয়া শিস!

ডুবুরি কি হয় কেউ, তপসি মাছের মতো
তোমার দেহের জলে? লগ্ন পাবে না কোন
ঘোলাজলে লালচে আভার, তবু দিনান্তে
পরম অঙ্গ আমার, বৈধ নারী তুমি জেনো—

স্ফোটন চির বিস্ময়কর, এই জঙ্গমে।

ডাহুকের ডাক শুনে তোমার ভাবনার সাথে
ঘন হয় সন্ধ্যেকাল। যে ফুল—
রাতেই জন্ম নিয়ে রাতেই গেছে ঝরে
এইসব শূন্যতায় তার রোদন গন্ধ মিশে আছে।

আর কোন গহন আমাকে টানে নি, তোমার দেহ
যেনো লতাগুল্ম বুনো, শিকারী কি ছিলাম
কোনকালে? ত্রিসীমার বনভূমি ভালো লাগে
আহা চন্দ্রবধু আমার, সূর্যমুখীর মা;
এই ট্যাটুর মতো তুমি আমাকে ক্লিভেজে আঁকো না!

নির্জন মঙ্গলালয় 

ওগো বন্ধু, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
নিজের প্রতি তুমুল সন্দেহ নিয়ে
শপথ— উদ্ভিদের বর্ণময় অংশের
শপথ— বন্ধনমুক্ত ছায়া উদ্দীপনার
শপথ— কুসুমসুগোল সৌরশক্তির
শপথ— নিষ্কলঙ্ক পাতায় কাঁচা সবুজের
হৃদয়স্থ টান, বেদনার্ত মুখ, আত্মসমর্পণ
এইসব হয়তো শেষতম দৃশ্য আমার

ওগো কর্ণধার, চারিদিক আলোহীন
মানুষেরা মানুষের দূরত্ব চায়
পৃথিবী— অস্ট্রেলোপিথেকাসের যাযাবর জীবন
পৃথিবী— মেডেলিন হরিণ শিকারী মেগানথ্রপাস
পৃথিবী— মায়া সভ্যতা, সিন্ধু, ব্যাবিলন
পৃথিবী— দেহ-পিঞ্জর, রক্তমাংস, স্নায়ুকম্পন
চিরণদাঁতে নরম চাঁদে কামড় বসানো জীবন
সব কোলাহল থেমে গেলো শোকে, মর্মর মিহি ক্ষণ

ওগো প্রাণনাথ, ছোঁয়াতো যাবে না স্পর্শে অসুখ
ক্রমশ বাড়ে আজরাইলের আসা যাওয়া বেধড়ক
সংশয় তবু গলা উঁচু করি
পৃথিবীর ভালো হোক
মানুষের জয় হোক।


Post a Comment

0 Comments