পাঁচটি অণুগল্প | মোহাম্মদ জসিম



রাষ্ট্রবিজ্ঞান

সে রাতে মহামান্য আইন তার দীর্ঘতম বক্তৃতা শেষ করে চুপচাপ ডিনার সেরে উঠে যান। তার উঠে যাবার পরও কেউ কোন গুঞ্জন তোলেনি, চুপ হয়ে গেছে পাথরের মতো। যদিও কাচভাঙা আর বেপর্দা জানালায় তুমুল বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার ঘাত-আঘাতে সৃষ্ট শব্দময় বিশৃঙ্খলার মধ্যে তার কথায় খুব একটা মনযোগ ছিলো না কারো।
ডাইনিং টেবিল অথবা সংসদ ঘিরে চেয়ারগুলো মন্ত্রী-উপমন্ত্রী সেজে চুপচাপ বসে থাকে। মহামান্য আইন যা বলেন নিঃশব্দে মেনে নেন তারা। তাদের বিশেষ কোন ব্যক্তিগত অভিমত নেই। কর্ণেল জামিল আনসারী ওরফে মহামান্য আইন দীর্ধকাল তার মন্ত্রীসভায় কোন রদবদল আনেননি। আনার দরকারও ছিলো না, সবাই বিশ্বস্ত, বাধ্যগত। ফলতঃ পা ভাঙা, হাতলভাঙা চেয়ারগুলো তাদের পাছার নিচে জমে থাকা পুরু মাকড়শাল জাল নিয়ে দিব্যি মন্ত্রীত্ব করে যাচ্ছে কালাকাল জুড়ে।
এ রাষ্ট্রে ভোটাভুটি হয় না।
কর্ণেল জামিল আর্মি থেকে অবসর নিয়ে যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন অনেকেই ভেবেছিলো তিনি হয়তো দেশের জন্য ক্রান্তিকারী নেতা হিসেবে আবির্বূত হবেন। হয়েছিলেনও কিছুটা। নতুন নতুন আইন করে দূর্নীতি কমিয়ে আনেন, উন্নয়নের পথও প্রশস্ত হচ্ছিলো। মাখাপিছু আয়ও ক্রমশ বাড়ছিলো। সমস্যা বাঁধালো স্বার্থান্বেষী বিরোধী দলগুলো। গাছ গাছ বোকা জনগনকে আকৃষ্ট করলো মিথ্যে স্বপ্নের জালে। বিদ্রোহী হলো তারা, ক্ষমতাচ্যুত হলেন কর্ণেলের মন্ত্রীসভা। কর্ণেল সেই থেকে গৃহবন্দী।
বন্দী কর্ণেলের ঘরে কেউ নেই আর। পাগলাটে কর্ণেল এত সহজে রাজনীতি ছাড়তে পারেন না। টেবিলকে তাই সংসদ বানিয়ে, চেয়ারগুলোকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে দিব্যি রাজনীতি চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে খাওয়ার আগে সংসদ বসান তিনি, বক্তৃতা দেন। মন্ত্রীরা চুপচাপ শোনে, আর শোনে তার পায়ের কাছে বসে থাকা পালতু কুকুরটি।
কর্ণেলের রাজনীতিতে এই কুকুরটির ভূমিকা রহস্যময়। ভিন্ন ভিন্ন চেহারার মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন নাম তার। কেউ ডাকে গনতন্ত্র নামে, কারো কাছে সে সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণপ্রজাতন্ত্র।
কর্ণেলের বক্তৃতা শেষে কিছুক্ষণ গায়েব থাকে কুকুরটি। সে আসলে বিপ্লবী নাকি স্পাই, নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

লকডাউন ও কয়েকটি ইলিউশন

রাস্তাগুলো আজ ছুটি নিয়েছে।
কে তাদেরকে ছুটি দিলো, কে দিতে চাইলো না—কিংবা আদৌ তারা ছুটিছাটা চেয়ে নিয়েছে কিনা, এসব প্রশ্ন অবান্তর। সম্ভবত, রাস্তাগুলো আজ কাউকে তোয়াক্কা করছে না।
রাস্তাগুলো উবে যেতে না যেতেই, তাদের রেখে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটা ফুলবাগান এসে দখল করার আগেই মানুষের ঘরবাড়ির দখলে চলে গেল। বাড়িগুলো মানুষের লোভ দ্বারা সংক্রমিত, বড় চোয়াল তাদের, সহজেই সবকিছু গ্রাস করে নিতে পারে।
সন্ধ্যা থেকেই কেমন অস্থির লাগছে সায়নের। গুমোট ঘরের আলো আঁধারি একদমই ভাল লাগছে না। হাঁটতে বেরোলো সে।
শহরে আজ এক রহস্যময় সন্ধ্যা নেমেছে। ঢিমে আলোর মধ্যে বিশৃঙ্খল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িগুলো, রাস্তা নেই। সামনে পেছনে ডানে বামে শুধু বাড়ি—দেয়াল আর দরজা, দরজা আর জানালা।
সায়ন একটি দরজা খোলে। সামনের আলো আলো ঘরটির শেষে আরেকটি দরজা। সেটি খুলে ঢুকলে আরেকটি ঘর, সাজানো গোছানো, পরিপাটি। সোফায় বসে আয়েস করে টিভি দেখছে রুবি খালা। তাকে হাই হ্যালো করে পরের দরজাটি খুললো সায়ন। এই ঘরটিতে আলো আছে মানুষ নেই।
দরজার পর দরজা খোলে সায়ন। পেরিয়ে আসে ঘরের পর ঘর। কোন ঘরে কাউকে পেলে কুশলাদি বিনিময় হয়, না পেলে চুপচাপ পেরিয়ে আসে।
প্রায় অন্ধকার একটি ঘরে দেখা হয় জাকিয়ার সাথে। সে তখন অন্ধকারে, ইনসোমনিয়া আর ডিপ্রেশনে হেলান দিয়ে চিঠি লিখছে। অন্ধকারে কেউ যখন চিঠি লেখে, বুঝতে হবে ওটি চিঠি নাও হতে পারে, হতে পারে সুইসাইড নোট।
সায়ন জাকিয়াকে জড়িয়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে। জাকিয়া তাকে তাড়িয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ দরজার ওপার থেকে এখনো ভেসে আসছে তীব্রতম চিৎকার।
পরের দরজায় দেখা হয় জামালের সাথে। পাওনাদার। বন্ধু সুবীর ছিলো পরের দরজায়। হাসমত চাচাকেও পাওয়া গেল। লোকটা বাচাল, তবু তাকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
সায়ন থামলো না। একটার পর একটা দরজা খুলছে সে, যেন শহরের শেষ দরজাটি না খুলে থামবে না আজ।
আলোবাতিহীন শেষ ঘরটিতে একটু সময় থামলো সায়ন। আয়না নেই, আসবাব নেই—রান্নাঘরে নেই কোন বাসন কোসন, অথচ একটি ফুলদানি দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, তার মুখে গোলাপ আর রজনীগন্ধা হাসছে। অন্ধকারেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে সে হাসি, অথবা কোন হাসিই ছিলো না, সবই সায়নের দেখার ভুল।
একটু বিশ্রাম নিতে হলো। তারপর সায়ন, খুলে ফেললো শহরের শেষ দরজাটি। দরজার ওপারে মাইল মাইল বিস্তৃর্ণ একটি বিশাল গোরস্থান। একদল লোক হাসিমুখে সার সার শবদেহ কবরে নামাচ্ছে।
তাদের একজন সায়নকে বললো, আসুন...।
জোর হাওয়ায় পাতা ঝরতে লাগলো বৃষ্টির মতো। লোকটির পায়ের নিচে গুড়িয়ে যাওয়া শুকনো পাতার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সায়নের।
চোখ মেলে সায়ন নিজের ঘরের দরজাটি ভাল করে দেখলো একবার, চেনার চেষ্টা করলো। খুললো না। দরজা খোলা মানা, লকডাউন চলছে।

টাকা ওড়ানোর দিন

হৈ হৈ রৈ রৈ হল্লামুখর মানুষগুলো ছুটছে তো ছুটছেই —পায়ের ওপর ভরসা নেই, আজ যেন ডানা গজিয়েছে সকলের। উড়ছে তারা।
বড় খবর, তাই আনন্দে বিস্ফোরিত চোখে আগু-পিছু দেখবার সময় কই!
মাখাপিছু আয় ১৭ পয়সা ছাড়িয়েছে! এর চেয়ে সুখের সংবাদ আর কি হতে পারে!
সরকার বাহাদুর ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন বড়লোক হবার আনন্দে শহরজুড়ে টাকা ওড়ানো হবে।
আজ টাকা ওড়ানোর দিন। যে যার সাধ্যমতো টাকা নিয়ে, নতুন পোষাক পরে, বাদ্য-বাজনা সহকারে তৈরি বসে আছে, এসেছে হরেক রকম রঙ। সরকারের প্রশস্তি গেয়ে কবি লিখলেন কবিতা, গায়ক সুর তুললেন চকচকে নতুন গানে, শিল্পী আঁকলেন ছবি।
দিলু কাকা, আমরা বড়লোক হয়ে গেছি!
কান্তা ভাবী, আমরা এখন ধনী!
নিত্যানন্দ, শুনেছিস আমরা এখন তিনবেলাই খাবো!
নাচছে ছেলে বুড়ো বৌ শ্বাশুরি হাঁড়পাকারাও। টাকা উড়বে, মন্ত্রী দেবেন ভাষণ, টিভিওয়ালারা করবেন সরাসরি সম্প্রচার।
কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধলো একদম শেষ মুহুর্তে। বাতাস নেই, টাকা উড়বে কিসে!
শোরগোল উঠলো জনতার মাঝে। দিশেহারা মন্ত্রীপাড়া। হতাশ রেডিও, টিভি, পত্রিকার প্রথম পাতারা। বাতাস চাই, টাকা উড়বে।
রাষ্ট্র গরীব নেই। সংবিধানেও আছে মিমাংসা—অতএব, শুধু শুধু সময়ক্ষেপণ কার স্বার্থে? বাতাস কিনে আনো, বাতাস আমদানি হোক পরদেশ থেকে।
আমদানি হলো বাতাস। বাতাস কিনতে ব্যয় হলো হাজার কোটি টাকা। সব টাকা উড়ে গেল, কখন গেল কিভাবে গেল টের পেলো না কেউ।
দিনশেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরলো সবাই। শুধু বাতাসে উড়তে থাকা টাকা দেখার শখ মিটলো না কারো।
খবরে প্রকাশ, আমাদের মাথাপিছু ঋণ ১৭ পয়সায় ঠেকেছে, মন্ত্রী বলেছেন...


পাখিদের বাজার সদায়

যো আকাশে মেঘ নেই, অতএব বৃষ্টিরও সম্ভাবনা নেই, তেমন এক আকাশের নিচে রোদ্দুরজর্জরিত বিশালাকার বটগাছটির নিচে একলা এক ঝুপড়ি দোকান। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়, টুকটাক মুদি মনোহারী, চা বিস্কুট আর খেলনা নিয়ে চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছি, ঝিমুচ্ছি।
প্রচণ্ড দাবদাহ, বাতাস ছিলো না। গাহেকও নেই।
হঠাৎ একটু দমকা হাওয়া, হাওয়ায় গাছের পাতা নড়লো একটু। হাওয়ার সাথেই কি জানি উড়ে এলো কিনা পাখিজোড়, চড়ুই আর টুনটুনি, রুমা আর ঝুমা।
নিস্তব্ধ দোকানঘর মুহুর্তেই ভরে ওঠে কূজনে, কিচিরে মিচিরে। দুজনে স্রোতের মতো কলকলায়, বাচালের মতো বকে।
দেখছোস পুতুলডা সুন্দার না! টুনটুনিটি বলে।
হহহহহ...এইরাম এট্টা আমার মিশু আপার আছে। জবাব দেয় চড়ুই।
চড়ুই চড়ুই শিশুপাখিটি আবার বলে, ওররে! দেখছোস গাড়িডা কি সুন্দার!
টুনটুনি হাসি ওড়ায় জোড়, বলে—এইডা আমার তিতলি বুবুর আছে।
দ্যাখ দ্যাখ, লাডুমখানা!
ওইডা আমার সুরুজ ভাইয়ার আছে।
দ্যাখ, ওই যে ঘুন্টি।
ওইডা ওড়ায় নাদিম কাকু।
ওই যে ওটা...
আমার মামার...
চড়ুই ওড়ে ফুরৎ ফারুৎ, টুনি ওড়ে... গল্প করে মামার চাচার ভাইয়ের বোনের প্রতিবেশীর।
মুঠো খোলে রুমা ঝুমা, পয়সা পয়সা ঝনঝনানি বাজতে থাকে দীর্ঘকাল। দুজন মিলে সাড়ে চার টাকা মোট। হাত পেতে আধুলি আর সিকিগুলো নিয়ে নেই। পয়সাগুলো মলিন আর পুরনো।
চকলেট কেনে ওরা। মুখে পুড়ে দেয় একেকটা। হেঁটে যায় নাচের ভঙ্গিতে, গানের সুরে গাইতে থাকে—ওইটা আমার দাদার আছে, ওইটা আমার....
দমকা হাওয়া আসে আবার। নাচতে নাচতে উড়ে যায় চড়ুই—টুনটুনি—রুমা ঝুমা মানুষের পাখি পাখি শিশুকন্যাগন। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকি ওদের উড়ে যাবার পথের দিকে।


তালাচাবি

নাহ, কোত্থাও নেই। টেবিল, শোকেস, আলমারি, ড্রয়ার, মেঝে কিংবা ডাইনিং—কোথাও নেই চাবিটি। বেমালুম গায়েব।
তাড়া ছিলো, তার ওপর চাবিটির এমন আচরণ! প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে দুম করে দরজাটি বন্ধ করে দিলো ছেলেটি, দরজায় তালা মারলো। তারপর হাঁটতে শুরু করলো, তার কাছে যে চাবি নেই এটা আর মনেই রাখলো না।
শহরের এ প্রান্তে মেঘ হলে ও প্রান্তে কি হয়! মেঘ না রোদ! আজ ও প্রান্তেও মেঘ। এ প্রান্তেও।
মেয়েটি পুরো বাড়িটি তন্নতন্ন করে খুজঁলো। চাবি আছে, তালাটি উধাও। মাঝে মাঝেই এমন হয়। এরকম সময়ে মেজাজ ধরে রাখা কষ্টকর। মেয়েটি দরজার সাথে রাগ দেখালো, তারপর হাইহিলে খুটখাট আওয়াজ তুলে রাস্তায় নেমে এলো। চাবিটি হাতব্যাগে, দরজায় তালা নেই আজ।
তাদের দেখা হলো শহরের ঠিক মাঝখানে, উদ্যানের শেষমাথায়, মেহগনি গাছের নিচে।
প্রচুর কথা বললো তারা। প্রেম করলো। চুমু খেলো, ঝগড়া করলো। তালা ও চাবি নিয়ে গল্প করলো টানা সতের মিনিট।
তারপর চুপচাপ। ভালবাসা গাঢ় হচ্ছে, হৃদয়টিকে বারবার ব্যবহার করার ফলে কেমন আটপৌড়ে লাগছে। তারা মনস্থির করেছে, এবার কিছুটা শরীর ব্যবহার করবে।
শরীরের কথায় মেয়েটি হঠাৎ চমকে ওঠে। তার শরীরে যোনি নেই, যোনিটি উধাও। ছেলেটিও চমকায়, তার শিশ্নটি নাই হয়ে গেছে। তারা একই দিনে তালা ও চাবি হারিয়েছে।
বিস্মিত তারা, একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তালা ও চাবি হারিয়ে দুজন যেন একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে—সমান সমান। তোমার যা আছে, আমারও তাই আছে। তোমার যা নেই, আমারও তা নেই।
সমস্ত হারানোর বেদনা ভুলতে চাইলো তারা। জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে, গাঢ় চুম্বন করলো। অথচ কোন অনুভূতি নেই, পাথর পাথর।
বুঝলে, সমান হয়ে গেলে আর প্রেম থাকে না। মন মরে যায়। বললো মেয়েটি।
ছেলেটি সায় দিলো।
এবার প্রেম খুঁজবে তারা। তালা ও চাবি খুঁজবে। হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে যতগুলো মানুষের সাথে দেখা হলো তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই জেনে নিলো তাদের তালা ও চাবিগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা।
দিনভর হাঁটলো, ছেলেটি ও মেয়েটি। কথা বললো খুইয়ে ফেলা তালা ও চাবি নিয়ে। কিছুই করার নেই তাদের। রাত হয়ে এসেছে, বাড়ি ফিরতে হবে।
আমার চাবিটি তুমি নিয়ে যাও। তোমার তো চাবি নেই। তালা খুলবে কি করে বাড়ি ফিরে?
নাহ, থাক। বরং তালাটি নিয়ে যাও তুমি। তালা থাকা জরূরী, নইলে চুরি হতে পারে।
তারপর, কি মনে করে মেয়েটি ছেলেটির হাত শক্ত করে ধরলো। বললো, চলো। আমার চাবি আছে, তোমার তালা। এক ছাদের নিচে আশ্রয় নিলে কোনটাই আর হারানোর সুযোগ পাবে না।


অতপর মহিমা একটি সন্দেহ ও দুইটি মার্বেল লইয়া ঘুমাইতে গেল

বেশি পাকলে যা হয়, ফেটে যায়—আর সেই ফাটা বেদানাটি টুপ করে মাটিতে পড়ে, লাল লাল দানাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় চারদিকে।
বেদানার দানার মতোই ছড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ। সারা রাস্তায়। হাঁটছে, দাঁড়াচ্ছে, বসছে।
এতগুলো বেদানার দানার মধ্যে মহিমা একটি দানা। দাঁড়িয়ে আছে। বাস আসলেই উঠে বসবে, চলে যাবে অন্য কোথাও, ছড়িয়ে পড়বে।
আরেকটা দানার নাম বিশু পাগলা। বেদানা কিংবা বেদনা কোনটাতেই তার কিছু যায় আসে না। কখন দাঁড়ায়, কখন বসে, হাঁটে নাকি দৌড়ায় তার হিসেব কাউকে রাখতে হয় না।
দাঁড়ি তো নয়, যেন একমুঠি শুকনো ঘাস। লম্বা কোঁকড়া চুল—তাতে আবার বিচ্ছিরি জটা। কালো চেহারা, নাকের ওপর কাটা দাগ। হলদেটে দাঁত, ততোদিক হলুদ তার চোখ। বিশু পাগলার চোখের দিকে তাকিয়ে ধক করে ওঠে মহিমার বুক! মার্বেলের মতো দুঁটো চোখ, যেন অগ্নি বর্ষণ করছে।
রিক্সার টুং টাং বাজে, মানুষের কথা বাজে, রাস্তার সাথে জুতার কথাবার্তা বাজে। বেচাকেনা চলে, খাওয়া দাওয়া চলে।
নানা মানুষ, নানান দৃশ্য। মানুষ কিংবা বাজার অথবা গাড়িঘোড়া না দেখতে চাইলে সোজা উপরদিকে আকাশ ছিলো। অথচ—বিশু পাগলার দিক থেকে মহিমার চোখ সরে না। কারনও আছে। বিশু পাগলা এক দৃষ্টিতে মহিমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মহিমা ভাবে, পুরুষ পুরুষই! পাগল হলেও। হারামী কোথাকার! কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে শরীরটা।
কণ্ঠ বাজে, আইসক্রিম খাবো মা।
বিশু পাগলা ভাবে, মা বোধহয়।
মহিমা ভাবে, পুরুষ মাংসাসী। পাগল হলেও।
আবার কণ্ঠ, রিক্সা নেবো আপু?
বিশু পাগলা ভাবে, বোন বোধহয়।
মহিমা ভাবে, পুরুষ কুত্তা। পাগল হলেও।
আবার কারো কণ্ঠ, আর কিছু কিনবি নাকি রুবি!
বিশু ভাবে, রুবি! মেয়ে বোধহয়।
মহিমা বুকের ওপর ভাল করে ওড়না টেনে দয়। দুজনার মাঠখানে একটা বাস এসে থামে।
মহিমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বিশু পাগলার ধ্যান ভেঙে যায়। মার্বেলের মতো চোখ দিয়ে কাকে যেন খোঁজে।
দিনশেষে মহিমা সবকিছু ভুলে যায়। শুধু ভোলে না বিশু পাগলার নোংরা মুখটি। মহিমা একটি সন্দেহ আর দু'টো হলদেটে মার্বেল সাথে নিয়ে ঘুমুতে যায়। এবং সেই রাতে মহিমা তার মৃত বাবাকে বহুদিন বাদে স্বপ্ন দেখে।

_____________________________________________
মোহাম্মদ জসিম
কবি ও কথাসাহিত্যিক

জন্মঃ ৩ এপ্রিল, ১৯৮৭, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কাঠিপাড়া গ্রামে
ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর, বিএম কলেজ বরিশাল থেকে
পেশাঃ সরকারী চাকুরিজীবি
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
১. ত্রয়োদশ দুঃস্বপ্ন, কবিতা, ২০১২
২. অসম্পাদিত মানুষের মিথ, কবিতা, ২০১৮
৩. মিথ্যেরা সাত বোন, কবিতা, ২০১৯
৪. তামাশামণ্ডপ, অণুগল্প, ২০২০
৫. কোলাহল চিহ্নিত, কবিতা, ২০২০
৬. অশ্বখুর ও অন্যান্য টগবগ, কবিতা, ২০২০

সম্পাদনাঃ পৃষ্ঠা (ছোটকাগজ)

Post a Comment

0 Comments