বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার গ্রন্থটি রচনা করেন ভারতীয় প্রাচীন রসায়নবিদ,চিকিৎসক দার্শনিক ও কবি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১০সালে "বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ"থেকে।বইটির মূল্য ছিলো এক আনা।সে বছরই বইটির ইংরেজি সংস্করণ আনে সিটি বুক সোসাইটি "Bengali Brain and its Misuse" নামে। প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণের পর বইটির তৃতীয় সংস্করণও আনা হয় চক্রবর্তী চ্যাটার্জী কোম্পানী থেকে।এ সময় বইটির ৩০০০ কপি করা হয়।বইটির মূল পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৯। সেই সংস্করণেরই একটি দূর্লভ কপি আমি পড়ি। বইটি কর্মবিমুখ,অলস,চাকুরী-প্রিয়,হীনমন্যতায় ভোগা বাঙালির জন্যে একটি দূরদর্শী রচনা এ ব্যপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র বলতেন তিনি ভুলক্রমে রসায়নবিদ হয়েছেন,তাঁর বরাবরই অনুরাগ ছিলো ইতিহাস,জীবনী সাহিত্য ও সাধারণ সাহিত্যের প্রতি। বইটি সম্পর্কে তিনি তার বিভিন্ন আলোচনায় বলেছেন "আমি বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণ করে তাদের দোষ-ত্রুটি দেখাতে দ্বিধা করি নি,অস্ত্র চিকিৎসকের মতোই তাদের দেহে ছুরি চালিয়েছি এবং ব্যধিগ্রস্থ অংশ নির্ণয় করে তার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছি।"
বইটির শুরুতেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় উল্লেখ করেছেন প্রায় সহস্র বছর যাবৎ হিন্দুজাতি একপ্রকার মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষে তিমিরাচ্ছন্নতার সূচনা হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রকাশের পর থেকে।এক্ষেত্রে তিনি সে সময়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক Weber এর মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন ভারতবর্ষে মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার শেষ নক্ষত্র ভাস্করাচার্য। তিনি দ্বাদশ শতাব্দীর বেশ কয়েক জন মহামহোপাধ্যায়'কে নিয়ে টিপ্পনী কেটে বলেছেন তাদের কাজ ছিলো বিবিধ টীকা রচনা করে টোলের ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক উৎপাদন করা।পরবর্তী সময়গুলোতে এ ধারা অপরিবর্তিত থাকে, এদিকে সে সময় ইউরোপের গ্যালিলিও,কেপলার,নিউটন প্রভৃতি মনস্বীগণ প্রকৃতির নতুন নতুন তত্ব উদঘাটন ও উপস্থাপন করছিলেন।
অন্ধকার এ অবস্থার জন্যে তিনি দায়ী করেন সে সময়ের হিন্দু সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিয়ম-কানুন'কে যা মানুষের মধ্যে বড়-ছোট জাত নির্ণয়ে ব্যস্ত ছিলো এবং সে সময়ে দুইশ্রেণীর লোকের ব্যাপক প্রভাব বিস্তার হলো।একশ্রেণী শাস্ত্রকার ও অপরশ্রেণী ব্যাখ্যাকার। প্রাচীন ব্রাহ্মণ সমাজের গ্রহণযোগ্যতা ও আধিপত্যতার পরের প্রজন্মের হিন্দুসমাজ তাদের পূর্বপুরুষদের মতো জ্ঞানচর্চায় মনোযোগ না দিয়ে শুধু পূর্বজদের নাম ব্যবহার করে নিয়মতান্ত্রিকার চাবুক কষে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চায় যার ফলে স্বাধীনচিন্তার সাথে সাথে তাদের মৌলিকতাও চলে যায়। তবে মাঝের সময়ে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি,বিকাশ ও ছড়িয়ে পড়ার সময়টায় স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটেছিলো।এ সময়ে জ্যোতিষশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন আর্চভট্ট,ব্রহ্মগুপ্ত,বরাহমিহিরসহ প্রভৃতি মনস্বীগণ। শাসনামল পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে নব্য হিন্দুসম্প্রদায়ের হাতে আবার ক্ষমতা চলে আসে সমাজ'কে শাসন করার এবং তাদের তৈরিকৃত কট্টর নিয়মের জন্যেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকেন। তারমধ্যে অন্যতম ছিলো কঠোর শাস্ত্রের তাড়না,জাত্যাভিমান,কুলমর্যাদা ও সমুদ্রযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা। অনেকেই মনে করেন মুসলিম শাসনামলের সময় ভারতে জ্ঞানচর্চাকে সে সময় অনেকাংশে ব্যহত করেন,তিনি এ ব্যাপারে পূর্ণ সহমত প্রকাশ করেন নি। তিনি বলেন,"সে সময়ে মুসলিম শাসন স্থায়ীরুপে প্রতিষ্ঠিত হয় নি,তাছাড়া মুসলিম শাসনামলেও বাংলা দেশে বিশেষত নবদ্বিপ ও বিক্রমপুরে হিন্দু-শাস্ত্রের যথেষ্ঠ চর্চা ছিলো।
ইংরেজ বণিকদের আগমনের পরে তারা যখন শাসন প্রতিষ্ঠা করলো বাঙালি সন্তানেরা তখন পূর্বজদের ব্যবসা ছেড়ে দলে দলে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মচারী নিযুক্ত হওয়া শুরু হলো। কিন্তু তারা এই সুযোগের অপব্যবহার করলেন এবং প্রতিটি বিভাগ থেকে কিছুই না শিখে কেবল নিজের আখের গোছানো শুরু করলো। বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর এ অবস্থার আরও উন্নতি হলো ঠিক কিন্তু ইংরেজ শাসকরা এদেশের তৈরি পোশাক পাশ্চাত্যে পাঠানো শুরু করলেন এর ফলস্বরুপ দেশের তাঁতি ও জোলাসহ ছোট ব্যবসায়ীরা জাতিগত ব্যবসা ত্যাগ করতে বাধ্য হোন। এ অবস্থার কারণে ভারতীয় দেশীয় শিল্পে সুতীক্ষ্ণ কুঠারাঘাত পড়ে। তখন ইংরেজদের কেরানিগিরি করা সমাজে সম্মানের বিষয় হিসেবে পরিলক্ষিত হওয়া শুরু হয় এবং বাংলার মনন ও মগজ চিরতরে চাকরপ্রবৃত্তিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং স্বাধীন চিন্তা নামক শব্দটি স্বযত্নে নিজেদের শব্দকোষে স্থান দিয়ে পরিত্রাণ লাভ করে। ইংরেজদের ছুঁড়ে দেয়া চাকরী লাভের আশায় বাঙালিরা ধীরে ধীরে মুখস্ত ও নির্দিষ্ট বিদ্যাচর্চায় মনোনিবেশ করলো। তিনি এর কারণস্বরুপ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার্জনের প্রতি ঝোঁককেই দায়ী করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মস্তিষ্ক ব্যকরণ ও অন্যান্য বে-দরকারী শাস্ত্র পাঠ ও আত্মস্ত করে বোঝাই হয়ে গেছে। এমন স্থিরচিত্তে যদি কেউ ব্যবসাও করে তবে তাতেও উন্নতি সম্ভব।
এছাড়াও তিনি বলেন " যতোদিন মানুষের মনে তাদের সহচরদের উপর প্রাধান্য লাভ করবার ইচ্ছা থাকবে,যতোদিন এক জাতি অন্য জাতিকে নিজের স্বার্থের জন্যে দাসশৃঙ্খলে বন্ধ রাখার চেষ্টা করবে সে জাতিকে শীর্ঘ্রই অন্যের দাসত্বে জীবন কাটাতে হবে।ভারতবর্ষ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্থল।"
বইটির শেষাংশে তিনি বলেন আপনি যদি সমাজের মত মতো না চলেন তবে সমাজ আপনার পথে বেত্রাঘাত করবে,আপনাকে একঘরে করে রাখবে।অথচ সমাজকে কলুষিত করে রেখেছে মিথ্যাচার।
এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ আবশ্যক এবং তা ধীরে ধীরে আসবেই। সেজন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তু হলো স্বাধীন চিন্তা,অন্যের গোলামির বলয় থেকে বেড়িয়ে স্বতন্ত্র কর্মসংস্থান তৈরি।
0 Comments