কাক ও অন্যান্য সময়
রাকায়েত রাব্বি
ঐ-যে কাকটা দেখা যাইতেছে কা কা করে ডাকতাছে ঐটা জয়নাল আবেদীনের কাক। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত কাকটা সবার আছিলো। যুদ্ধের পরেই এই কাকটা হইয়া গেছে মর্গা মিয়ার। গরুর রচনার মতো মর্গার ব্যাপারে যদি কইতে হয় তাইলে মর্গা প্রথমত একটা কৃষক তারপর ঈশ্বরের বহু নামের মতো তারো বহু নাম আছে। মর্গার চোখ, কান, হাত, পা সব আছে খালি প্যাটটা নাই!
জয়নাল আবেদীনের এই কাকটা তারে ছাড়ে না। সারাদিন কা কা করে। মর্গা শূন্য হানকিটা ছুঁইড়া মারে কাকের দিকে। কিন্তু তবুও কাক কা কা করতেই থাকে। মর্গা তার জীবনে কতবার যে এই হানকিটা কাকের দিকে ছুইড়ক মারছে তা কাক নিজেও জানে না। কারণ সে যে গতিতে ছুইড়া মারে তা কাকের কাছে গিয়া পৌঁছায় না। রাগে গরগর করতে পারে না মর্গা। সে হুস হুস কইরা তাড়াতে থাকে কাক। তার হুস হুসের শব্দ শুনে মনে হয় যুবতী মেয়ের চরম পুলকের সময় কামরস আর লিঙ্গের ঘর্ষনে যে শব্দ সৃষ্টি হয় সেই শব্দ ভাইসা আসছে। কাক হয়তো শুনবার পারে হয়তো পারব না। কিন্তু মর্গাকে ছাইড়া কোথাও যায় না।
মর্গা আর হুস হুস করার ক্ষমতাও রাখে না। তার মনে হইতে থাকে সেইসব দিনের কথা। যখন এই কাকটা হানকিটার সামনে বইসা থাকতো আর মর্গা শূন্য হানকিটার সামনে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া হস্ত মৈথুন করতো। কাকটা চাইয়া থাকতো শাদা ভাতের ফ্যানার লাইগা। কিন্তু নাই, মর্গার শরীরে শাদা ভাতের কোন ফ্যানা নাই।
তখন মায়া হইতো কাকটার লাইগা।
তখন নুরুলদীন আছিলো। এখন নুরুলদীন নাই!
তখন যুদ্ধ প্রায় শেষ। মিলিটারিরা গ্রাম দিয়া ভাগতেছে। ইটা ক্ষ্যাত আছিলো। নিজের গায়ের মাংস কুচি কুচি কইরা কাটে মর্গা, তারপর ইটামুগুর দিয়া ইটা বাইরিয়া ভাঙ্গতে থাকে। জমি বীজ বোনার উপযুক্ত কইরা নিজের শরীরে মাংস ছিটাইতে থাকে মর্গা। জয়নুল আবেদীনের কাকটার জন্য কষ্ট হয় তার।
ঐ কাকটায় কি চায়?
ঐসব দিনের এক চৈত মাইস্যা দুপুরে মর্গা তার কুচি কুচি করা মাংস ছিটানোর জন্য ইটামুগুর দিয়া ইটা ভাঙ্গতাছিলো। তার চোখে পরে দূরে এক মিলিটারি বন্দুক কান্দে কইর্যা ইটা ক্ষ্যাতের উপর দিয়া আসে। বন্ধুক দেইখা মর্গা ভয় পায় না, তার মনে পড়ে জয়নুল আবেদীনের কাকটার কথা। সে ইটামুগুর নিয়া ধাওয়াতে থাকে মিলিটারিকে। এই আমান আমান পাথরের মতো ইটার উপর দিয়ে মিলিটারির দৌড়াতে পারে না কিন্তু মর্গা পারে। মর্গার পা মিলিটারির বোটের থেকেও শক্ত।
মিলিটারি ইটার উপর পরে যায়। মর্গা এবার ইটা ভাঙ্গতে শুরু করে। তার চোখে বারবার ভাইসা উঠে কাকটার চোখ। কেমন চোখ বন্ধ কইরা থাকে খাবারের আশায়!
মর্গা ইটা ভাঙ্গতে থাকে, মর্গা ইটা ভাঙ্গতে থাকে, ইটা মর্গা ভাঙ্গতে থাকে, ইটা মর্গা ভাঙ্গতে থাকে, মর্গা ইটা ভাঙ্গতে থাকে, ইটা মর্গাকে ভাঙ্গতে থাকে। ইটা ভেঙ্গে যায়।
মিলিটারি পিপাসায় কাতরাতে থাকে। একটু পানি খাইতে চায়। এইবার আর মর্গার চোখে কাক ভাসে না। ভাইসা উঠে ফারাক্কার বাঁধ, তিস্তার বাধ সহ আরো অনেক বাধ। মর্গার মনের ভেতর সব বাঁধ ভাইঙ্গা যায়। কল কল কইরা পানি আসতে থাকে। এই পানি কোন দেশে আছিলো? কই থিকা আহে এতো পানি? এই পানি কি শুধুই পানি না এই পানির নাম জল!? মর্গা বুঝে না। চোখ মেইলা দেখে কোন পানি নাই, জল নাই!
পানি খুঁজতে থাকে মর্গা, পানি মর্গাকে খুঁজতে থাকে। কেউ কাউকে খুঁজে পায় না। এই চৈত মাইস্যা দুপুরে দিগন্ত জুইরা ইটা ক্ষ্যাতে পানি কই পায়। খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়। অবশেষে একটা বর্ষার শামুক খুঁইজা পায় মর্গা, বর্ষার না হইলেও বৃষ্টির হইবোই।
সেই শামুকের পানি খাওয়ায় মিলিটারিরে। ইটা কাদা হইয়া যায়। মর্গার গায়ে তখন জোর আছিলো, বুকে বল আছিলো। জয়নুলের কাকের জন্য মায়া আছিলো। কারণ তখন এস এম সুলতান ছবি আঁকাইতো।
এখন মর্গা কাক খ্যাদায়। হুস হুস করে। শব্দ হয় যুবতী মেয়ের চরম পুলকের সময় কামরস আর লিঙ্গের ঘর্ষনে যে শব্দ সৃষ্টি হয় সেই শব্দের মতো। কাক হয়তো শুনবার পারে হয়তো পারে না।
0 Comments