নারীর যৌনতা থেকে উত্সারিত সন্তান
হাঙরি আন্দোলন মূলত দুই পর্বে সঙগঠিত হয়। একটা শুরু হয় শৈলেশ্বর ঘোষ ও বাসুদেব দাসগুপ্তের সাম্পাদনায় ক্ষুধার্ত’র মাধ্যমে, যাকে হাঙরি আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব বলা যেতে পারে। আর সূচনা পর্বে ছিলো, মলয় রায়চৌধুরী সমীর রায়চৌধুরী ত্রিদিব মিত্র আলো মিত্রদের দ্বারা সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন, জেব্রা, উম্মার্গ, wastepaper, সহ আরও অনেকগুলো পত্রিকা ও বুলেটিন। হাঙরির প্রথম দিককার কবি সুবিমল বসাকের সাথে ফালগুনী রায়ের প্রথম সাক্ষাত হয়। হাংরি আন্দোলনের ইস্তেহার ও জেব্রা’র প্রথম সঙখ্যা পড়ে মূলত ফালগুনীর হাঙরিদের প্রতি আকর্ষণ হয়। ১৯৬৪ সালে হাংরি জেনারেশনে মলয় রায়চৌধুরীর প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার জন্যে মাললা হয় এবঙ তা ১৯৬৭ সাল অবদি চলে। তারপর হাঙরি আন্দোলনের পথিকৃতরা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিলেও, অনেকেই অন্য পথে হাঁটা শুরু করলেও ফালগুনী কখনো চলে যায়নি হাঙরিদের ছেড়ে, হাঙরিদের চিন্তাগুলো ছেড়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছেড়ে। দিনে দিনে ফালগুনী রায় নিজেই রূপ নেয় অনন্য এক হাঙরি প্রতিকে।
ফালগুনী রায় জীবনকেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছে। বেঁচে থাকতে গিয়ে তার চোখের সামনে দেখেছে কতোজন বেচে দিয়েছে নিজেকেও। তাই জীবনের বিরুদ্ধেও তার আচরণ খুব দ্রুত ফালগুনীকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। ফালগুনী মনে করতো কবিতার মাধ্যে দিয়েই তার পূনর্জন্ম হয়েছে, কবিতার মধ্যেই পাওয়া যাবে তার প্রতিষ্ঠানবিরোধি জীবন। তার ৩৫ বছরের জীবনের ৪২ কবিতাই তার পুনর্জন্ম। তাই তার বেঁচে থাকাটা তার কাছে তেমন প্রয়োজনিয় কিছু মনে হয়নি। জীবনে বেঁচে থাকার প্রতি তার কোনো হা-হুতাশ ছিলো না। এবঙ তার এই বিশ্বাস তাকে লেখিয়ে গেছে চরম প্রতিষ্ঠানবিরোধি তার কবিতাগুলোকে ।
আজ তোমাদের পৃথিবীর পাশে আমার এই স্বমারণোত্সব
আমার সেচ্ছা মৃত্যুর এই গান
আমায় দিয়েছে এনে নির্বাণের মহাসম্মান
(কালো দিব্যতা ।। ফালগুনী রায়)
মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা দ্বিতীয় সংখ্যায় তার প্রথম লেখা ছাপা হয়। তখন তার বয়স মাত্র ১৯। তারপর মূলত হাঙরিদের সম্পাদিত পত্রিকাগুলোতেই তার লেখা ছাপা হয়, বিশেষ করে বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পাদিত ক্ষুধার্ত পত্রিকায় তার অনেকগুলো লেখা ছাপা হয়।
১৫ আগষ্ট ১৯৭৩ সালে হাংরি জেনারেশন প্রকাশনা থেকে বাসুদেব দাশগুপ্ত মাত্র ১৩টি কবিতা নিয়ে ১৬ পৃষ্টায় ফালগুনী রায়ের প্রথম এবঙ একমাত্র কবিতার বই নষ্ট আত্মার টেলিভিসন চটি আকারে প্রকাশ করেন। যার ব্যাককাভারে লেখা ছিলো- ’জীবনানন্দ যেসব শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর চোখে দেখেছিলেন যেসব শূকরীর চিতকার কানে শুনেছিলেন, তাদের সন্ততিরা- সন্ততির সন্ততিরা আমার চারপাশে এখন চিতকার করছে- আমি জানিনা আমার কবিতা দিয়ে সেইসব চিতকার থামানো যাবে কিনা’ ।
আনন্দবাজারি সম্পাদক ক্ষমতালোভি সাহিত্যিক কফি হাউজের পাণ্ডাকবি পারিবারিক লোকজন পরিচিতজন সবার বিদ্রুপ সহ্য করে করে অবশেষে ৩১ মে ১৯৮১ ফালগুনী রায় মারা যান। যে ফালগুনী রায় জন্মে ছিলো ৭ জুন ১৯৫৪ সালে ।
কিন্তু কবি ফালগুনী রায় মারা যায়নি। নষ্ট আত্মার টেলিভিসনের ব্যাককাভারে লেখাটি বুঝিয়ে দেয়, যে শূকরীরা জীবননান্দকে বিষ্ন্নতায় ঘিরে আরে সেই শূকরীর বঙশধররাই ফালগুনী রায়কে ঠাট্টা বিদ্রুপ অবহেলায় ঘিরে রাখতো। কিন্তু তার মৃত্যুর পরপরই নতুন লেখিয়েরা ফালগুনী রায়ের লেখার প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করে । এবঙ অসঙখ্য পত্রিকায় তার লেখা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ফালগুনী ঠিক তা-ই জানতো, যদিও সমাজ-রাষ্ট্র তাকে বাঁচতে দিবে না, কিন্তু এই কবিতা কবিতার ভেতরের প্রতিবাদ শব্দের চিতকার প্রতিষ্ঠিত সবকিছুকে ঠেলে ঠেলে কবিতার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়ার চিত্রকল্পগুলো তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
আমি যেন আমার মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকি
নারীর যৌনতা থেকে উত্সারিত সন্তানের মধ্যে নয়
কিন্তু শুধু শব্দের শরীরে থাকুক বেঁচে
আমার চেতনা
(কবিতা হঠাও ।। ফালগুনী রায়)
আমি ঈশ্বর কিমবা শূয়ারের সন্তান নই
তার মৃত্যুতে তাই কোথাওসভা হয় না, কোথাও একটু শোকপ্রকাশ হয় না, কোথাও কেউ দু’কলম লিখে না। আসলে এটাই ছিলো কবি ফালগুনী রায়ের সফলতা। প্রতিষ্ঠানগুলো কেনো ফালগুনীর জন্যে শোক দেখাবে। তাদের তো পোয়াবারো। প্রাতিষ্ঠানিক কবিরাতো শত্রুমুক্ত হলো। তার এখোন বিশ্রি পাছা ফুলেয়ে বাঁধাবিহিন হাঁটতে পারবে কফিহাউজ থেকে শুরু করে বাঙলা কবিতার সভাসম্মেলনগুলোতে, তাদের পাছায় লাথি মারার কেউ রইলো না।কবিতার ভেতরের হোক কিঙবা কবিতার বাইরের হোক, ফালগুনী রায় কোনো হিন্দু ছিলো না কোনো মুসলমান ছিলো না কোনো খৃস্টান কিঙবা কোনো বৌদ্ধ অথবা জৈন ছিলো না; শুধু একজন মানুষ ছিলো । সে ছিলো ফালগুনী রায় । মৃত্যু অবদি যে বিশ্বাসবিহীন কাটিয়ে দিয়েছে তার অস্থির অক্লান্ত অমার্জিত যৌবনযাত্রা। উলঙগ কবিতাযাত্রা।
‘না বাপু-আমি ঈশ্বর কিমবা শূয়ারের সন্তান নই
স্রেফ মানুষের বাচ্চা-আপনিতুমিসেতাহারা রয়ে গ্যাছে
আমার ভেতর-আমার ভেতরে আছে স্মৃতির কবর
শব্দের অন্তহীন খনি আর পরমব্রহ্মের অণ্ডকোষ
ধরে ঝুলে থাকা আস্তিক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসভূমিতে
আমি একা উদোম ন্যাংটা ঘুরে বেড়াই বিশ্বাসবিহীন
খুব সহজ নিশ্বাসে-’
(আমি মানুষ একজন ।। ফালগুনী রায়)
0 Comments