মোহাম্মদ জসিমের দুটি অণুগল্প

 


মুখবদল

গত বছর আমি ছিলাম গরু, তার আগের বছর গাধা, তারও আগের বছর ভোতামুখাে শুয়াের। বছরের শুরুতে কোন না কোন পশু-পাখির মধ্যে ঢুকে যাই আমি, বছরের শেষদিন বের হয়ে আসি। একবার কিং কোবরা সাপের মধ্যে ঢুকে গেছি, বিষের থলিটি পেয়ে আমার সে কি আনন্দ। নিজেকে মনে হতাে আজরাইল, চাইলেই যে কারাে জান কবজ করতে পারি। পরের বছর ইঁদুর হলাম, সাপের নজর এড়িয়ে জীবন বাঁচাতে কি প্রাণান্ত শ্রমটাই না গেছে! প্রতিটি মুহুর্তে দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসতাে এই বুঝি সাপের ছােবলে মরলাম। 

একবার কুকুরের শরীর নিয়ে মানুষের ঘৃণা ও ভালবাসা কুড়িয়েছি। মানুষ এক আজব জীব, একবার ভালবেসে কোলে তুলে নেয়, খেতে দেয় নুন- ফেন, পরক্ষণেই ঘৃণাভরে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেয়। যেবার ঘােড়া হলাম, ঘাস খেতে বিরক্ত লাগতাে। অথচ আমি মনে মনে ঘােড়ার মতাে গতিশীল জীবনই চাইতাম। 

খরগােশের জীবন অভিনয়ে ভরা, শিয়ালের চাতুর্যও আমাকে মানায় না। বিশালবপু হাতি, হিংস্র হায়েনা, গর্জাতে থাকা বাঘ, কেশর দোলানাে সিংহ কিংবা ঘাড়উঁচু জিরাফের জীবন থেকে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষতক চুপচাপ পড়ে ছিলাম দিন সাতেক, ভাবলাম একা একা। 

আত্মপরিচয় খুঁজতেখুঁজতে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছি অজস্র পশুর জীবনে। নিজেকে খুঁজে পাইনি তবু। মাঝে মাঝে মনে হয় এই খোঁজাখুঁজির শেষ কোথায়?

আদৌ কি শেষ আছে এর! মাস ছয়েক হলাে, মানুষের জীবনে আছি।

শুরুতে মানুষই ছিলাম, পুনরায় সেই জীবনে ফিরে এসেও খুব একটা শান্তি যে মিলছে, তা নয়। তবুও, এই জীবনেই থেকে যাবাে ভাবছি।

কেননা মানুষই একমাত্র প্রাণী যার মধ্যে এক চিমটি করে সকল প্রাণীর দোষ-গুণ বিদ্যমান। মানুষের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি বিষ, সাপের

ছােবল, ছােবল এড়ানাে ইঁদুরের ভয়-ভীতি, সিংহের সাহস, কুকুরের ঘৃণা আর বিড়ালের শরীরে রাখা ওম।


যেমন খুশি তেমন সাজো


ছেলেটি মঞ্চে এসে দাঁড়ালাে। বললাে- আমি মানুষ সেজেছি। 

তার কথায় চমকিত হবার মতাে কিছু ছিলাে না। তার সাজপােশাকেও কোন বিশেষত্ব নেই। সাদামাটা স্কুলড্রেস পরনে। তবু কেন যেন বিচারকরা হতচকিত হলেন, নড়েচড়ে বসলেন।

দ্বিতীয় প্রতিযােগীটি যখন মঞ্চে এলাে বিচারকরা আবারও নড়ে বসতে বাধ্য হলেন। সে বলেছিলাে- আমি ধর্ষক সেজেছি। তার পােশাকও অবিকল প্রথম ছেলেটির মতাে।

তৃতীয়জন মঞ্চে এলাে, বললাে- আমি খুনি সেজেছি।

চতুর্থজন বললাে, আমি দুর্নিতীগ্রস্থ রাজনীতিবিদ।

পঞ্চমজন বললাে, আমি দিনমজুর এবং ভােটার।

বিচারকগণ একটু অবাক, তারা দেখছেন তাদের সামনে একই রকম হাত পা চোখওয়ালা মানুষ যেমন মানুষ দেখে তারা অভ্যস্ত, এবং তাদের সাজপােশাকও অবিকল একরকম। অথচ তারা এসেছেন যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযােগিতায়, যে সবচেয়ে ভাল, ব্যতিক্রম এবং কৌতূহলউদ্দীপক ঢঙে সাজবে তাকেই প্রথম ঘােষণা করবেন।

বিচারকদের একজন বললেন, এ কেমন সাজ! সবাই তাে অবিকল এক। 

আরেকজন মন্তব্য করলেন, মানুষটিকে প্রথম করা হােক।

অন্যরা প্রতিবাদ করলেন, কেননা নিয়মানুযায়ী যে ভাল সাজবে সে প্রথম হবে, আর, এখানে সবার সাজই একরকম। অতএব সবাই বিজয়ী।

বিচারকদের বিতর্ক থামে না। প্রতিযােগীরাও অপেক্ষা করছেন।

বিভ্রান্ত বিচারকমন্ডলী শেষ পর্যন্ত কাউকেই বিজয়ী করতে পারলেন। তারা ফিরে গেলেন যার যার বাড়িতে, যে যার নিজস্ব মুখােশ ও সাজপােশাকের ভেতরে।


সে রাতে কারােরই ভাল ঘুম হলাে না। ভাবছিলেন শুধু, মানুষ দেখতে

অপরাধীর মতাে, অপরাধীও অবিকল মানুষের মতাে।


Post a Comment

0 Comments