স্বর্ণ রঙের চিল || সৌর শাইন || গল্প


মিতালী ফিরে এসেছে। সাথে ফিরেছে পুলিশের জীপ। ফিরে এসেছে আরো কিছু মেয়ে। এই ফিরে আসাটা কতটা সুখের আর কতটা দুখের তাই আজ জিজ্ঞাসা।


পুলিশের জীপ থামলো চোখকানা হাটে, একেবারে অতসী নদীর ঘাটপাড়ে। কারণ, ওদের একজনের বাড়ি নদীর ওপাড়ে আনন্দপুর গাঁয়ে। সে একজন আমাদের গল্পের চরিত্র মিতালী। মেহরাব দর্জির বড় মেয়ে সে। দেখতে কালো হলেও মায়াবী বদন, দোহারা দেহের গড়ন। এসএসসি ফেল করার পর আর পড়াশোনা হয়নি। দরিদ্রতার জীবন, থেমে থেমে খেয়ে না খেয়ে চলা বড় সংসার। মিতালীরা পাঁচ বোন, ভাই নেই। একটা ছেলে সন্তানের আশায় মেহরাব দর্জি এতোগুলো সন্তানের জন্ম দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত মনোবাসনা পূরণ হলো না। মেহরাব দর্জি বউ আনোয়ারা বেগম বলে, ‘খোদার ইচ্ছার উপরে কোনো দাবি নাই। যা দিয়েছে তাতেই শুকরিয়ানা। আইজ কাইল মেয়ে বেটিরাই মা বাপের সমাদর করে। কত লোকের ঘরে দেখা যায় বেটারা পর্যন্ত ভাত দেয় না। মেয়ে বেটির মতো মায়া বেটাদের হয় না।’

মেহরাব দর্জিও বউয়ের কথায় সায় দিয়ে বলে, ‘আমার জন্যি খোদা বেহেশত নসিবে রাখছে, মাইয়া নাই যাগোর তাগোর কপালে বেহেশত পাওয়া বড়ই কঠিন।’

এইসব আহ্লাদী কথায় কেটে যায় কত দিন-রাত।


মিতালীর ছোটো বোনদের নাম শেফালী, সোনালি, রূপালি, দীপালি। মিতালী ও শেফালী পিঠাপিঠি, সোনালি স্কুলে পড়ে, রূপালি-দীপালি এখনো অনেক ছোটো। মিতালী ও শেফালী সংসারের আয়ের জন্য কাজ করত মোড়ল পাড়ার রাইস মিলে। মোড়ল পাড়াটা আনন্দপুর গাঁয়ের একেবারে পূর্বপ্রান্তে। ওরা সেই সকাল বেলা বেরিয়ে যেতো, ফিরতো সন্ধ্যের আগে প্রায় সূর্যডুবা অন্ধকার আমেজে। দুপুরের খাবারটুকু সাথে নিয়ে যেতো, কখনো খাবার নেওয়া সম্ভব না হলে, না খেয়েই দিন কাটিয়ে দিতো। মাস শেষে যা আয় হতো, তাই তোলে দিতো বাবার হাতে, সংসারের খরচ চালানোর উদ্দেশ্যে। এভাবেই দিনগুলো কেটে গেলে মন্দ হতো না।


মিতালীর সাথে রাইস মিলের এক যুবকের সখ্য হয়। গড়ে ওঠে ভালোলাগা, ভালোবাসা। যুবকটির নাম আসাদুল। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ওর কাছ থেকে মিতালী জেনেছে, সে কতটা ভাগ্য বিড়ম্বিত, ঘর ছাড়া ও নিরুপায় হয়ে রাইস মিলে কাজে এসেছে। কাজের মধ্যেই একটু একটু কথা বলা ও চোখে চোখ রাখা। হাসি ঠাট্টার সিঁড়ি বেয়ে জাগে প্রেমালাপ। প্রথমদিকে মিতালী একেবারে রাজি ছিলো না। মিতালী বলেছিল, আমি গরিবের বেটি, এইসব করন আমারে মানায় না। মানুষ শুনলে বদনাম হইবো।

আসাদুল বলেছিল, তোমার মত আমিও তো গরিবের পোলা। বড়লোকেরা যদি প্রেম কইরবার পারে, আমরা কি দোষ করলাম? এতো ডরানির কী আছে? প্রেম হবে গোপনে মানুষ শুনবে কেমুন কইরে?

তখন মিতালী আর সাড়া দেয় না। হেসে কাজে মন দেয়। তুষের আগুনে ধান সেদ্ধ করা, সেগুলো রোদে শুকানো, উত্তপ্ত পাকা উঠোনে ধান পায়ে নেড়ে উল্টে পাল্টে দেওয়া, শুকনো ধান থেকে পরিচ্ছন্ন চকচকে চাল করে বস্তাবন্দি করা এসব ঘর্মাক্ত কষ্টকর কাজে দিন পেরিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত আসাদুলের আবেগ অনুরোধে মিতালীর মন বিগলিত হয়ে ওঠে। একদিন আসাদুলের আই লাভ ইউ, শব্দ তিনটির প্রতিউত্তরে মিতালী জানায়, আই লাভ ইউ টু। গোলাপ দেওয়া-নেওয়া, কাজের ফাঁকে চোখের ইশারায় আড়ালে আবডালে যাওয়া, কাছাকাছি হয়ে দুষ্টুমি করা এভাবে চলে প্রেম।

মিতালীর প্রেমে পড়ার কথাটা কেউ না জানলেও শেফালী ঠিক বুঝতে পারে। বড় বোনকে এজন্য খোঁচা দিয়ে কথা বলতেও ছাড়ে না।

একদিন তো বলে ওঠে, বুবু আমাকে না জানিয়ে এমনটা করা কি ঠিক হইতেছে?

মিতালী যেন আকাশ থেকে পড়ে। কি কইতেছিস কিছুই তো বুঝতে পারতেছি না। খুইলা ক তো।

শেফালী চিরায়ত স্বভাবসুলভ ভেংচি কেটে বলে, থাউক গা, আর ঢঙ করন লাগবো না। আমি তো তোর পর, আমারে কইবি কের লাগি?

এবার হাসে মিতালী। তুই আমার আপন বোন, পর হতে যাবি কেন?

কামের ফাঁক-ফোকরে আসাদুলের লগে যে কী করতেছিস, তা কি আমার চোখে পড়ে না?

মিতালী হাসতে হাসতে তেড়ে আসে, দূর ফাজিল কোথাকার, তোর এতোদিকে নজর থাকে ক্যা?

শেফালী গা বাঁচিয়ে দৌড়ায় আর বলে, আমার সামনে পিছে তিরিশ চোখ, তাই সব দেখবার পারি.. হা হা হা।

মিতালীও হাসতে হাসতে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।


সেই মিতালী আজ ফিরে এসেছে। আনন্দপুর ঘাটে নৌকা থেকে নামা মাত্র মানুষজনের ভিড় জমে যায়। ছোটো বড় সবার মনে প্রশ্ন ও কৌতূহলের ঝড়! মিতালী এতোদিন কোথায় ছিলো? কী হয়েছিল মিতালীর? দু’জন নারী কন্সটেবল নৌকা থেকে নামে। একজন বলে, মিতালী, তোমাদের বাড়িটা কোন দিকে?

মিতালী ধীর স্বরে উত্তর দেয়, পাঁচ-সাত মিনিটের পথ মেডাম। হাঁইটাই যাওন যাইবো।

ওরা তিনই হাঁটতে শুরু করে। পেছনে ত্রিশ চল্লিশ জনের জটলা। মিছিলের মতো এগিয়ে আসছে।


আসাদুল মিতালীর প্রেম অতি গোপনে চলছিল। চান্স পেলে একটু-আধটু গল্প করা। কারোর উপস্থিতি টের পেলে চট করে কেটে পড়া, যেন একজন আরেকজনকে চিনেই না। সবার অগোচরে কাছে আসা, চুমুর মতো স্পর্শে সজাগ কাতরতা নিশ্বাসের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেওয়া। একদিন আসাদুল বলে, চলো, মিতালী, সদর থেকে সিনেমা দেখে আসি। জব্বর একটা সিনেমা চলতেছে।

মিতালী অনীহা জানিয়ে বলে, এতো সাধ জাগে কেন? প্রেম করতেছো তাতে কি আঁশ মেটে না?

আসাদুল মুচকি হেসে বলে, এই জনমে কি আর আঁশ মিটবে? যত কাছে আসবে, আরো কাছে টানিবার মোন চাইবে। বুঝলা মিতালী!

শেষে মিতালী রাজি হয়। বলে, কবে যাইবা তারিখ ঠিক করো, চাঁতালের মালিকের কাছ থেইক্যা আগেভাগে ছুটি নেওন লাগবো।

আসাদুল পরের মাসে তারিখ নির্ধারণ করে এক তারিখ সোমবার। আর ঐ দিনই দু’জনের ছুটি নেবার পরিকল্পনা করা হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঐ দিনটি আসে, জেলা সদরে ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা দেখা ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করার ইচ্ছে পূরণের দিন। কিন্তু ধান চাঁতালের মালিকের কাছ থেকে মিতালীর ছুটি মিলেছে, আসাদুল ছুটি পায়নি। এতে মিতালী হতাশ হলেও, আসাদুল বলে, ছুটি দেয়নি তাতে কী হইছে? ঠিক আমরা চলে যাব, পরে যা হবার হবে। কী আর করবে? জরিমানা ধরে বেতন থেকে দুয়েক শো কেটে রাখবে।


সোমবার সকালে মিতালী সেজেগুজে বের হয়। শেফালী বুঝতে পারে আজ কাজে যাচ্ছে না বড়বুবু, তাড়া থাকায় কোনো প্রশ্ন করেনি, নিজের মতো চাঁতালে চলে যায়। মিতালী ও আসাদুল চোখকানা হাটের ঘাট থেকে মুকুরগঞ্জ উপজেলার ট্রলারে ওঠে। তারপর উপজেলা থেকে সিএনজি ট্যাক্সিতে চড়ে জেলা সদরে।

মিতালী বলে, আমরা তো মুকুরগঞ্জের সিনেমা হলেই ছবি দেখতে পারতাম। এতো দূর যাওনের কী দরকার?

আসাদুল জানায়, হ, সিনেমা দেহোন যাইতো ঠিকই, কিন্তু চাইনিজ রেস্টুরেন্ট কপালে জুটতো না, বুঝলা?

মিতালী মাথা নাড়ায়।  


দু’জন কন্সটেবলসহ মিতালী বাড়ির উঠোনে পা রাখে। মেয়েকে দেখা মাত্র বাবা-মা কাঁদতে শুরু করে। তীব্র আহাজারি ও বিলাপে গাঁ কেঁপে ওঠে। কন্সটেবল দুজনকে কেউ দুটো চেয়ার এগিয়ে দেয়। ওরা বসে, কেউ হাত পাখাও বাড়িয়ে দেয়। মিতালী বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে বাঁধ ভাঙা কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। গগন বিদারী চিৎকার করে মিতালীর বাবা মেহরাব দর্জি বলে, খোদা তোমার দুয়ারে শুকরিয়া জানাই, তুমি আমার মাইয়ারে ফিরায়া দিছো। মেহরাব দর্জিকে একজন কন্সটেবল বলেন, আপনার মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন, এর জন্য এখানে একটি স্বাক্ষর দিতে হবে।

মেহরাব দর্জি কাঁপা কাঁপা হাতে নাম স্বাক্ষর করে। কন্সটেবল দু’জন চলে যাবার সময় বলে, আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে একবার থানায় আসবেন। মামলার বিষয়ে কিছু কাজ রয়েছে।


এদিকে আনোয়ারা বেগম, মেয়েকে দুধ দিয়ে গোসল করানোর আয়োজন করে। সারাজনমের পাপ ধুয়ে মুছে মিতালীকে ঘরে তুলতে চান। অন্যদিকে উঠোন জুড়ে ভিড় জমিয়েছে কয়েকপাড়ার লোকজন। সবার একটাই প্রশ্ন, মিতালী এতোদিন কোথায় ছিলো? মৃত মাছের চোখের মতো ঘোলাটে দৃষ্টিতে মিতালী সবার দিকে তাকায়, কণ্ঠস্বর থেকে সাড়া আসে না।


সেদিন সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসাদুল মিতালীকে নিয়ে গিয়েছিলো একটি আবাসিক হোটেলে। চমৎকার বিলাসবহুল হোটেল দেখে মিতালী অবাক না হয়ে পারে না। বারান্দায় হেঁটে, বাইরে তাকিয়ে, রুমের সৌর্ন্দয ও টাইলস বসানো বাথরুম এক এক করে সবকিছু দেখতে থাকে। খানিকটা ভুলে যেতে থাকে, তাকে ফিরতে হবে। আসাদুল দুপুরের খাবার অর্ডার করে। কিছুক্ষণ পরেই হোটেল বয়, বিফ সিজলিং নিয়ে আসে। দু’পাশাপাশি বসে ওরা খাবার খেয়ে নেয়। এক সময় আসাদুল চুমুর আদরে কাছে টেনে নেয় মিতালীকে। মিতালী বুঝতেও পারে না কী হতে চলেছে। জামা খোলার পর হঠাৎ ওর হুশ হয়, নিজেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করে। ততক্ষণে আসাদুল তার ভেতরের রূপে উদ্ভাসিত হয় তীব্র উত্তেজনায়। ভেস্তে যায় মিতালীর অনিচ্ছা। সব থমকে যাবার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে। আসাদুল জানায়, কান্না করার কী আছে? বিয়ের পর তো এসব হবেই, আমাদের না হয়, আগেই দুয়েকবার হইলো।


দিন শেষে রাত নেমে আসে। আসাদুলের ফেরার ইচ্ছে নেই। সারারাত ওরা হোটেলেই কাটায়। শেষ রাতে মিতালীর চোখে তন্দ্রা নামে। তখন আসাদুল মোবাইলে কথায় ব্যস্ত তখন। ঘুমের ঘোরে মিতালী শুনতে পায়, না না বস। আড়াই লাখের নিচে আমি পারবো না। আহ্, বললাম তো ফিগার চমৎকার, আপনার বিজনেস ভালো হবে, টেনশনের কিছু নেই। আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে দু’লাখেই আছি।


সকালে আসাদুল যখন জামা গায়ে বের হচ্ছে, তখন মিতালী বলে, আমি তো এখনো রেডি হইনি, তুমি কই যাচ্ছো?

আসাদুল বলে এতো তাড়ার কী আছে? আমি তো চলে যাচ্ছি না। নিচে যাই, নাস্তাটাও নিয়ে আসি, হাতের কাছে পত্রিকা পেলে তাও নিয়ে আসবো।

মিতালী আর কথা বাড়ায় না। ওয়াশরুমে যায়। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে আসাদুলের কথা। তাকে তো কখনো চাঁতালে পত্রিকা পড়তে দেখা যায়নি, আজকে হঠাৎ পত্রিকা আনতে যাবে কেন?


মিতালী রেডি হয়ে বসে থাকে আসাদুলের অপেক্ষায়। দুই ঘণ্টা পর রুমে তিনজন মধ্য বয়স্ক মহিলা আসে। ওরা বলে, আপনি মিতালী?

হাঁ।

আসুন, আপনার স্বামী আসাদুল সাহেব নিচে ট্যাক্সিতে আছেন।


মহিলাদের সাথে মিতালী নিচে নেমে যায়। দেখতে পায়, আসাদুল ট্যাক্সির সামনের সিটে ড্রাইবারের পাশে বসা। আসাদুল বলে, মিতালী তুমি পেছনে ওদের সাথে বসো, আমি সামনে আছি। মিতালী ট্যাক্সির পেছনের সিটে গিয়ে বসে। দু’জন মহিলাও সাথে বসে, মিতালীকে ওরা মাঝখানে বসতে দেয়। মিতালী দেখতে পায়, আসাদুল ট্যাক্সি থেকে নেমে যাচ্ছে, আর অপর মহিলাটি সামনের সিটে বসে পড়লো। মিতালী আসাদুলকে ডাকতে যাবার মুহূর্তে একটা রুমাল ওর মুখে চেপে ধরে।


গ্রামের মানুষজনের অজ¯্র প্রশ্নের কাছে টিকে থাকা ভারি কঠিন। মিতালী তিনদিন পর কিছুটা সুস্থ হয়। তাকে ঘিরে সবার মধ্যে গুঞ্জন। বাঁকা কথা বলতে পটু সবাই, গ্রামের নারীরা এক্ষেত্রে কয়েকধাপ এগিয়ে। এসব ঘটনায় নারী হয়ে নারীর দুঃখ বোঝার ক্ষমতাটুকু ওদের লোপ পেয়ে যায় প্রায়ই।


মেহরাব দর্জি মেয়েকে নিয়ে মুকুরগঞ্জ থানায় আসে। ওসি আসাদুল সম্পর্কে নানা তথ্য জিজ্ঞেস করে। আসাদুলের বাড়ি কোথায় বা ঠিকানা কিছুই জানে না মিতালী। থানা থেকে রাইস মিলের মালিক ইব্রাহিম খাঁকেও তলব করা হয়। ইব্রাহিম খাঁ আসাদুলের কিশোরগঞ্জের ঠিকানা দেয়। কিন্তু, ওটা ভুল প্রমাণ হয়। তার প্রকৃত নাম আসাদুল কিনা তাও স্পষ্ট নয়।

সেদিনের মতো ওরা বাড়ি ফিরে আসে।

গ্রামের লোকজনের কৌতূহল দিন দিন বাড়তে থাকে। জোয়ান-বুড়ি নারীরা বাড়ি এসে মিতালীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসে, এই ছয়-সাতটা মাস কইছিলি ছেঁড়ি? পুলিশে তোকে কোতথেইকা ধইরা দিয়া গেল? 

মিতালী নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকে। এসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে ওর ভেতরটা পাথর হয়ে উঠেছে। এদিকে ইব্রাহিম খাঁর মুখ থেকে থানার প্রশ্ন ও আসাদুলের কথা প্রকাশের পর সারা গাঁয়ে ঝড় উঠে যায়। অকপট হিং¯্রতা মানসিক অত্যাচারের বহর বয়ে আনে।


ঐদিন ট্যাক্সি মিতালীকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, তা সে জানে না। চোখ মেলে কেবল একটা সাজানো গোছানো ঘরে নিজেকে দেখতে পায়। দিনের পর দিন কেটে যায়। তিন বেলা তিনমুঠো খাবার আসে, তাই খেয়ে পেটের যন্ত্রণা উপশম করে। এক সপ্তাহ পর কিছু নির্দেশনা আসে। মিতালী বুঝতে পারে, সে অন্ধ কূপে পড়ে গেছে, এখান থেকে নেই উদ্ধারের উপায়। করুণ নিয়তি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে ওকে। কিন্তু সে উপায়টুকু হাতের কাছে ধরা দেয় না।


প্রথমবার এক মদ্যপ বুড়ো তাকে ভোগ করতে আসে। মিতালী কিছুতেই নিজেকে ধরা দেয় না। জোর করাতে খাটের পায়ায় চেপে ধরে বুড়োকে। টেনে হিঁচড়ে ওঠতে চেষ্টা করলে মিতালী ধরাস করে বুড়োর মাথা ফাটিয়ে দেয়। বুড়ো রক্তাক্ত হয়ে অজ্ঞান! এই ঘটনার পর মিতালীর উপর নেমে আসে নির্মম অত্যাচার। এরপর থেকে মেনে নিতে হলো সবকিছু। রোজ তিন চারজন পুরুষের আহার মেটাতে হয়। এক একটা দিন নরককু-ের মতো যন্ত্রণাময়। শরীর ভক্ষণের আনন্দে উপর নিচ সব তলার মানুষেরা হাজির হয় এখানে। শকুনের নখ আর হায়েনার দাঁত তখন ওদের শরীরে দৃশ্যমান। কামড়ে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে স্তন ও যোনীর দিক দিগন্ত!


গাঁয়ের লোকজনের মুখে মুখে প্রচার পায় মেহরাব দর্জির মেয়ে এতোদিন বেশ্যালয়ে ছিলো। সেখান থেকে পুলিশ ধরে এনে বাড়ি দিয়ে গেছে। ছিঃ ছিঃ শব্দের কোরাস শোনা যায় চারদিকে। মেয়ের এই বদনামে দিশেহারা হয়ে পড়ে মেহরাব দর্জি। মানুষের মুখের উপর কথা বলার সাহস হয় না। যেনো জগতে তাদের মতো অপরাধী দ্বিতীয়টি কেউ নেই। কয়েকমাস কেটে যায়। মানুষজনের গরম আলোচনায় অন্য কিছু ঠাঁই নিলে পূর্বের স্মৃতি কিছুটা রক্ষে পায়। তেমনি সামাজিক আলোচনা কমে আসার পর মেহরাব দর্জি মেয়েটাকে বিয়ে দেবার চেষ্টা করে। ঘরে আরো চারটি মেয়ে আছে ওদেরও তো বিয়ে নামক ভবতরী পাড় করতে হবে।

পাত্র পক্ষকে যৌতুক দেবার শর্তে মিতালীর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু, সে বিয়ে ভেঙে দিতে সজাগ ছিলো পাড়ার কিছু কূটমনা নারী-পুরুষ। মেয়ে দেখতে আসা পাত্রের স্বজনদের কাছে নানা বর্ণনা ভঙ্গিমায় প্রকাশ করে নানা কথা। মেয়ে চরিত্রহীন, বেশ্যাবৃত্তি করে প্রভৃতি। অতঃপর সহজ সূত্রে ভেঙে যায় সবকিছু। মেহরাব দর্জি কেঁদে খোদার কাছে নালিশ জানায়, কেন এই শাস্তি দিচ্ছো মাবুদ!

কিন্তু অস্তিত্বহীনতার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না।


মিতালী কাঁদতে ভুলে গেছে। সারাদিন কারোর সাথে কথা বলে না, পাথুরে মূর্তির মতো নিশ্চুপ বসে থাকে। শেফালী ও ছোটো বোনেরা ডাকলেও সাড়া দেয় না। সেদিন মিতালী বারান্দায় বসে ছিলো। উঠোনের কোণে একঝাঁক মুরগির ছানা চিঁ চিঁ করে বেড়াচ্ছে। আজকাল এসব দৃশ্য দেখা ছাড়া অন্য কিছু ভেবে শান্তি পায় না। বার বার দুঃস্বপ্নের মতো হিং¯্রতা উঁকি দিয়ে উঠে। গত পরশু ছানাগুলো ডিম থেকে বেরিয়েছে। কোমল পালকের কারুকাজ ছোটো ছোটো শরীরে। সুন্দর রূপ লাবণ্য যত দিন যায় ততই হ্রাস পেতে থাকে। ওদের উপর আক্রমণ আসে নানা দিক থেকে। চিল, কাক, বেজি, বনবিড়াল উৎ পেতে থাকে সবাই। এই তো সেদিন একটা ছানার উপর বেজি কামড় বসিয়েছিল, তবু প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে। সে ছানাটা এখনো অন্যদের মাঝে ঘুরে ফিরে ছুটে বেড়াচ্ছে। ছানাটার মাথার দিকে চামড়া উঠে গেছে, খুলিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেখানে দাঁত বসিয়েছে সেখানে গর্ত হয়ে আছে, কিছুটা মগজও দেখা যাচ্ছে। ছানাটি অন্য ছানাদের সাথে তাল মেলাতে গিয়েও পারছে না। প্রতিটি ছানা বার বার মাথার ক্ষত স্থানে ঠোঁকর দিচ্ছে! দুর্বলকে আরো দুর্বলতর করে তুলছে। এ দৃশ্য মিতালীর চোখে তীব্র জ্বলুনি সৃষ্টি করে, কিছুতেই মানতে পারে না এসব।


সামান্য ঝগড়ার সূত্র ধরে আনোয়ারা বেগমকে প্রতিবেশি রশিদের বউ বলে, তোর মেয়েরে কি এমনি এমনি ধরে নিয়ে গেছে মর্দেরা? কত পোলার লগে যে লাইন মারতো, সেসব কতা চাঁতালের বেবাকতে জানে। কুচরিত্রা মাগী, মাইয়াগুলাও বানাইতেছিস বেশ্যা-খানকি। 

খুঁচানো মন্তব্য এখানেই থেমে নেই। মিতালীর ছোটো বোন সোনালী এবার হাইস্কুলে সিক্সে পড়ছে। ওর স্কুলে যাবার পথে বখাটে ছেলেরা বাজেভাবে বলে, বোনের মতো করবি ঘষাঘষি? আমরা আছি জানালে আইসা পড়মু, জায়গা মতো।


যে নরকে কেউ ঢুকলে কখনো বেরিয়ে আসার পথ পায় না, অথচ সেখান থেকেও মিতালী মুক্ত হলো। ঐ বেশ্যালয়ের মালিক ছিলো আজিজুল মন্ডল নামের এক লোক। টাকার বিনিময়ে সে দেশের শহর-গ্রামে লোক লাগিয়ে মেয়ে কিনে আনত। তারপর সারাজীবনের মতো যৌন দাসী বানিয়ে দেহব্যবসায় বাধ্য করে। এভাবে দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছে অসীম প্রতিপত্তি। আর যেসব মেয়ে স্বেচ্ছায় আসে এই ব্যবসায়, তাদের ক্ষেত্রে আলাদা হিসেব। অর্ধেক অর্ধেকে মুনাফা ভাগাভাগি।  

মিতালীসহ ওখানে প্রায় একশোর মতো বন্দি মেয়ে ছিলো। সকাল সন্ধ্যা আসতো খদ্দেররা। মেয়েদেরকে সারিবদ্ধভাবে বসানো হতো গেস্টরুমের পাশের রুমে। খদ্দেরা এসে প্রথমে গেস্টরুমে বসে, মদ পান করে, সিগারেট টানে টিভি দেখে। তারপর পাশের রুমে ঢুকে মেয়েদের ঘুরে ফিরে দেখে পছন্দ করে নিতো। কাউন্টারে হিসেব চুকিয়ে বিছানায় উপভোগ।

উঁচু তলার খদ্দেরদের ওখানে মেহমানদের মতো সমাদর করা হতো। শিল্পপতি বা বড়লোকেরা এলে আজিজুল মন্ডল নিজে এসে সবকিছু তদারকি করত। একদিন আজিজুল মন্ডলের সাথে এক ভদ্রলোক ঘুরে ফিরে মেয়েদের দেখছিল। হেঁটে যাবার সময় হঠাৎ ঐ ভদ্রলোকের হাত থেকে একটি কার্ড নিচে পড়ে যায়। ওটা ছিলো ভিজিটিং কার্ড। মিতালী সবার অলক্ষ্যে ওটা কুড়িয়ে তোলে। কার্ডে লেখা আজিজুল মন্ডলের নাম, সাথে দেওয়া কর্পোরেট অফিসের ঠিকানা ইত্যাদি। সেদিনই মিতালী প্রথম জানতে পারে সে ঢাকার একটি সুপরিচিত স্থানে আছে।

তারপর একদিন টিভি বিজ্ঞাপনে শুনতে পায়, পুলিশের সাহায্যের জন্য ডায়াল করুন ৯৯৯ নম্বরে।

মিতালীর ভেতর মুক্তির পরিকল্পনা গড়ে উঠে।


একদিন এক খদ্দের ওকে ভোগ শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে লোকটার মোবাইল কব্জা করে মিতালী। ওয়াশরুমে ঢুকে কল দেয় ৯৯৯ নম্বরে। এক এক করে বিস্তারিত বলে। আজিজুল মন্ডলের অফিসের ঠিকানায় বিশ মিনিট পর পুলিশ এসে হাজির হয়। উদ্ধার করে মিতালী ও মিতালীর মতো শতাধিক মিতালীকে। বিজনেসের লাইসেন্স নিয়ে নারীদের জিম্মি করে গড়ে তোলা পতিতা ব্যবসায় নিমিষে গুঁড়িয়ে যায়। 


মিতালী দিনের পর দিন, খেয়াল রাখছে ঐ অসহায় ক্ষতাক্ত ছানাটির উপর। তার খুব ইচ্ছে ছানাটির শেষ পরিণতি দেখার। অন্য ছানাদের ঠোঁকর খেয়ে ধুঁকতে থাকে, তবুও সে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। রাত হলে খোঁয়ারে ফিরে যায়, সকালে আবার বেরোয়। মিতালী একদিন শুনতে পায় উঠোনের পাশে মুরগির ছানাদের চিৎকার হৈ চৈ। বারান্দা থেকে উঁকি দিতেই দেখতে পায় একটি স্বর্ণ রঙের চিল। তারপর থেকে ঐ ছানাটি আর দেখা যায়নি।


পিতার দুরাবস্থা দেখে মিতালী কী করবে ভেবে পায় না। একদিন বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে গার্মেন্টস কারখানায় চলে যায়। আর কখনো বাড়ি না ফেরার প্রতিজ্ঞা করে। কাজ করে দিন কাটছিল, সেখানেও একদিন দেখা মেলে গাঁয়ের পরিচিত মুখের। বিপত্তী পথ ছাড়ে না। কথার গন্ধ সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায়। কাজ শেষে ফেরার পথে যুবক শ্রমিকরা কাছে ঘেঁষতে চায়, টাকার বিনিময়ে শরীর পাবার প্রস্তাব করে। তখন মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত মিতালী। ভেবে ভেবে দিন কাটাতে থাকে, চোখের সামনে ভেসে উঠে বৃদ্ধ পিতার মুখ, নিরীহ ছোটো বোনদের কথা, খেটে ক্লান্ত মাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে তুলতুলে মুরগির ছানাটির শেষ পরিণতি, যে পথ থেকে ছানাটি বেঁচে ফিরেছিল, সবাই তাকে ঐ পথেই আবার ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। মিতালী নিজেকেও সেই আগের পথেই ভাসিয়ে দেবার কথা ভাবতে থাকে। শরীর পিপাসু যুবক শ্রমিকদের প্রস্তাবে একদিন সাড়া দিতে শুরু করে। আয় রোজগার বাড়ে, বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারে। দিন যেতে যেতে বুঝতে পারে গার্মেন্টস কারখানায় থাকাটা মিতালীর উচিত নয়।


নানা দিকে যোগাযোগ একদিন মিতালী পছন্দ মতো আশ্রয় খুঁজে নেয়। মালিক পক্ষের সাথে ভাগাভাগির বিষয়টাও আলোচনায় ফাইনাল করে। মিতালীর ফিফটি ফাইভ পার্সেন্ট, থার্টি পার্সেন্ট হোটেল মালিকের, ফিফটিন পার্সেন্ট ভাড়া, খাবারের খরচ বাবদ। কাজ করার স্বাধীনতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা মিতালীর উপর নির্ভর করবে। যাচ্ছে দিন স্রােতের মতো। স্বর্ণ রঙের চিলের হাত ধরে মিতালীর দিন কাটে।


একদিন রাতে মিতালি জামা ও পারফিউম কিনে শপিংমল থেকে ফিরছিল। ওভার ব্রিজে একটি পা বিহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখে। ঝকঝকে আলোয় পরিচিত চেহারাটা ঠিক বোঝা যায়। লোকটার গলায় ঝুলানো কার্ডে স্পষ্ট লেখা ‘একটি মানবিক আবেদন। আমার নাম আসাদুল। গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার শরীর থেকে পা’দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন।’


মিতালি হ্যান্ডব্যাগ থেকে লাল রঙের একটি দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তর তর করে নেমে যায়।

Post a Comment

0 Comments