দেহ পালিত সাপ : একটি আহত স্বপ্নের চন্দ্রপুরাণ
অদ্ভুত অথচ মায়াময়ী কুয়াশার আস্তরণ বিছিয়ে রাখে কিছু কবিতা। কিছু কবিতা হৃদয়ের অতলে সুখের দোলা দিয়ে যায়, আবার কিছু কবিতা রেখে যায় অপার্থিব কিছু সুসঙ্গতি যা হৃদয়ের অলিগলিতে অনবরত বাজিয়ে যায় স্বপ্নের সজীব অথবা বেদনার্ত অনুরণন। এসব কবিতার একান্ত ছন্দময়তা। তবুও কবিতা আসলে নিছক কবিতাই, আর কিছু নয়। অনেকটা মরিচীকার মানসসুন্দরী বললে কম বলা হয় না, যার আকর্ষণ-বিকর্ষনে অন্তত কাটিয়ে দেয়া যায় পুরো একটি জীবন। কিছু কিছু স্বপ্ন অথবা বেদনার অন্তর্লীন জগত নিয়ে গড়ে উঠে কবিতার ভুবন। যার কেন্দ্রে থাকে কবি, তার হৃদয় লালিত অনুভব, প্রতীক, ছন্দ, স্মৃতি- বিস্মৃতি, দহন, ব্যাক্তিত্বের সংকট, সভ্যতার অবনমন নিয়ে। একবিংশ শতাব্দীর মূল সুর মূলত ব্যাক্তিত্বের সংকট তথা সমগ্র মানব সভ্যতার সংকট। এই দ্বন্দ্ব মূলত মানবের সাথে যন্ত্রের, আবার মানবের সাথে পচন উন্মুখ সভ্যতার। এই সকল দ্বন্দ্বমুখর ছন্দের উত্থান-পতন আজকের দিনের কবিতাগুলোয় খুব নিবিরভাবে চোখে পরার মতো। ফলে কবিতাগুলো হয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের মতো সুকঠিন অথচ চোরাবালির চেয়েও গভীর ও দুর্ভেদ্য। কিছু কিছু কবিতা হৃদয়ের এলোমেলো চিন্তাভাবনাকে এতোটাই গভীরে নামিয়ে দেয় যে হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পরে যাবে যে কেউ, অনায়াসে। এইটাই মূলত আজকের দিনের কবিতার বিশেষত্ব যা কবিতার দেহে পরিয়ে দিয়েছে কঠিন অথচ স্নিগ্ধ লাবণ্যপ্রভা। তবুও কবিতা কবিতাই, তার জায়গা থেকে সে চির যৌবনা, মুখরিত সৌন্দর্যের স্বপ্নময় আলিঙ্গন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, শব্দ প্রয়োগে মিতব্যয়িতা ও অর্থঘনত্ব সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে।আপাতদৃষ্টিতে, আমাদের কাছে সেসব অর্থহীন এবং অপাঙতেয় মনে হলেও তা অর্থের দিক দিয়ে অনেকটা গভীর ও বুদ্ধিদীপ্ত। এক গভীর বোধে তাড়িয়ে নিয়ে চলে আমাদের তার ভাষা এবং বক্তব্যের সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম কারুকাজ।
প্রথমত, এই কাব্যগ্রন্থটি আবর্তিত হয়েছে
মূলত সাপ নামক একটি
সরীসৃপ কে কেন্দ্র করে
যা আঙ্গিক এবং
গঠনে সম্পূর্ণ আলাদা
ও চমক জাগানিয়া। একই
বিষয়কে কেন্দ্র করে
একদম নতুন ভাব
ও মাধুর্যে কবিতা
লেখা অনেকটা শ্রমসাধ্য কাজ,
যা তিনি সুনিপুণ কারিগরের মতো
গড়ে তুলেছেন তিলে
তিলে। এগুলো মূলত
সিরিজ কবিতার কাতারে দাঁড়
করানো যায়। একই
বিষয়-বস্তুকে কেন্দ্র করে
সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে একেকটি
কবিতার অবয়ব গড়ে
তোলাই মূলত এই
সকল কবিতার প্রকৃত
উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়ত, তার মিথলজি(পুরাণ) এর
ব্যবহার কবিতায় অন্য
একটি আবেদন এনেছে।
ফলে, কবিতায় উপমা,
উৎপ্রেক্ষা এবং অলংকারগুলো অনেক সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর উপায়ে
গেঁথে গেছে প্রত্যেকটি পঙক্তির পরতে
পরতে। জীবনের সূক্ষ্ম বোধ
থেকে মূলত জন্ম
নিয়ে থাকে এসব
পুরাণ। এক্ষেত্রে, কারও
মনঃসংযোগ যদি এক
মূহুর্তের জন্যেও অন্য
দিকে ঘুরে যায়,
তবে তার কবিতা
অনেকটা দুর্ভেদ্য ও
অজেয় ঠেকবে।
তৃতীয়ত, তার অতি
সুক্ষ্ম জীবনবোধের যে
অনুরণন আমরা পাই
তার কবিতার মাঝে
তা অনেকটাই জীবন
প্রসূত ও অভিঘাত
সংশ্লিষ্ট। প্রাত্যহিক জীবনের
যে ঘটনাপ্রবাহ আমাদের
বয়ে নিয়ে চলে
দিক থেকে দিগন্তে , তা
থেকেই মূলত তার
শব্দসমষ্টির উৎপত্তি। তার
প্রত্যেকটি কবিতাই যেন
এক একটি জীবনগাঁথা যা
মানব হৃদয়ের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। এছাড়াও
তার কবিতায় প্রেম
ও দ্রোহ এক
অনন্য রূপ লাভ
করেছে।
চতুর্থত, তার ভাষা
ব্যাবহারের সংকোচহীনতা। এক্ষেত্রে বাকরীতি ও
কাব্যরীতির মিশ্রণ ঘটেছে
যাতে গদ্যের ভাষা,
প্রবাদ, প্রচলিত শব্দের
ব্যাতিক্রম ব্যবহারের মাধ্যমে ভাষার
ব্যবধান বিলোপের চেষ্টা
করা হয়েছে। কিছু
কিছু ক্ষেত্রে, শব্দ
প্রয়োগে মিতব্যয়িতা ও
অর্থঘনত্ব সৃষ্টির চেষ্টা
চলেছে। আপাতদৃষ্টিতে, আমাদের
কাছে সেসব অর্থহীন এবং
অপাঙতেয় মনে হলেও
তা অর্থের দিক
দিয়ে অনেকটা গভীর
ও বুদ্ধিদীপ্ত। এক
গভীর বোধে তাড়িয়ে
নিয়ে চলে আমাদের
তার ভাষা এবং
বক্তব্যের সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম কারুকাজ।
কাব্যে আধুনিকতা বলতে সচরাচর আমরা যা বুঝি তা প্রকৃত অর্থে আধুনিকতা নয়। অর্থাৎ শুধু সময়ের দিক দিয়ে আধুনিক হলে আধুনিক কবিতা হয় না। নতুন সময়ের জন্মে, নতুন ভাবে নির্ণীত, নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ গড়ে ওঠাতেই সেসব কবিতার সার্থকতা। দেহ পালিত সাপ কাব্যগ্রন্থ মূলত সেই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে, যা অনেকটা অবনমিত ও ক্ষয়িষ্ণু। যে 'সাপ' কে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিটি কবিতা গড়ে উঠেছে, তা মূলত এই সময়ের গান গেয়ে যাচ্ছে। কখনও এই সাপ আমাদের হৃদয়ে বেড়ে উঠছে পরম মমতায়, কখনও বা মননে রেখে যাচ্ছে একান্ত কিছু ক্ষত, কখনও হয়ে উঠছে বিধ্বংসী, আবার কখনও বা স্নেহময়ী। আবার কিছু ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠছে রাষ্ট্রযন্ত্র তথা পুরো সমাজিক শোষণ নিপীড়নের হাতিয়ার। আবার কখনও 'সাপ' নিজেই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেব-নিকেশে। কবিতার মূল স্রোতকে গতি প্রদানের লক্ষ্যে অনেক সময় কবি 'সাপুড়ে ও বেদেনীর' অনুষঙ্গ এনেছেন। যা উদ্দীপক কে একটি নির্দিষ্ট প্রতীক ও ছন্দে তরঙ্গায়িত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রথম পাঠে যে অর্থ লক্ষ্য করা যায়, তা পৌনঃপুনিক পাঠে হয়ে উঠে অনেক গভীর এবং মর্মস্পর্শী। এক্ষেত্রে কবির কাব্যগ্রন্থ থেকে নিচে কিছু পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
[২] 'ভোগের
লুটপাটতন্ত্র শিখে
নিয়ে তাইতো সকল
কিছু সাপ হয়ে
গেছে।'
[৩] 'মৃত্যুর পর
সব দেহ সাপ
হয়ে যায়। এই
বিভ্রমের জ্যোৎস্না রাতে
সাপগুলো দেহ থেকে
বের হয়ে আসে!'
[৪] 'খোলা
হাটের ভেতর ঢুকে
পড়েছে রাষ্ট্রীয় সাপ।'
[৫] 'আজ আমরা সাপের দলের লোক, দুধ-কলা আমাদেরই প্রাপ্য'
[৬] 'দেহের
সাথে দেহ মিলিয়ে
গড়ে তুলবো, দেহ
পালিত সাপের খামার'
সাকিব শাকিলের কবিতাগুলোর দিকে যদি একটু পর্যবেক্ষণ দৃষ্টিতে তাকাই তবে অনুধাবন করতে পারবো, তার জীবনের বোধ কতটুকু তীক্ষ্ণ এবং শাণিত। জীবনের পরতে পরতে যে গ্লানি, আনন্দ, বেদনা, উল্লাস লুকিয়ে আছে তা তার কবিতার প্রত্যেক পঙক্তিতে পাখপাখালির কলকাকলীতে মুখরিত। কাব্যের মুকুর প্রণয়তাড়িত হয়ে যে জটিল জীবনের আস্বাদে সংক্ষুব্ধ, তার উজ্জ্বল
দৃষ্টান্ত যেন কবি সাকিব শাকিলের কবিতা
চার.
পুরাণ এর ব্যবহার আধুনিক সাহিত্যে বিশেষ করে বলতে গেলে কবিতায় একটি চিরায়ত ধারার সৃষ্টি করেছে। ফলে, কবিতাগুলো অনেক ক্ষেত্রে অসংলগ্ন এবং এলোমেলো মনে হলেও, তা অনেকাংশে পরস্পর নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। এজন্যে আধুনিক সাহিত্যে পুরাণ এর একটি বিশেষ প্রতীকী মূল্য রয়েছে। এটি মূলত আবেগ এবং অভিজ্ঞতাকে খুব গভীরভাবে যুথবদ্ধ করে রাখে এবং একটি তথ্যের পর অপর তথ্যের একটি নিবিড় ও হৃদয়স্পর্শী সংযোগ গড়ে তোলে। ফলে পুরো লেখা বা কাব্যের মাঝে একটি নিবিড় অর্থঘনত্ব এবং মগ্নতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। এক্ষেত্রে, আমরা ইলিয়ট এর কবিতায় পুরাণের ব্যাবহার লক্ষ্য করতে পারি যা তার কবিতাকে একটি অন্য মাত্রার গতি এনে দিয়েছে। তার 'ওয়াস্ট ল্যান্ড' কবিতাটি এর অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত। এই কবিতাকে অনেক সময় আধুনিক কবিতার এজেন্ডা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও তার আগে বিশেষ করে "রোমান্টিক কবিদের" কবিতায় গ্রীক এবং রোমান পুরাণের অতিমাত্রার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। যদিও অনেক ক্ষেত্রে কোন কিছু অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে তা ম্লান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবুও সেসব তাদের কবিতায় অতি ব্যবহারের ফলে তা এক অন্যরকম ব্যঞ্জনা পেয়েছে। এসব কবিদের মধ্যে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এস. টি. কোলরিজ, জন কীটস্, পিবি শেলী এবং লর্ড বায়রন অন্যতম। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে আধুনিক কবিতায় জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং পরবর্তীতে শামসুর রাহমানের কবিতায় চিরায়ত লোককাহিনী, পুরাণ ও প্রাচীন মিথের ব্যাবহার উল্লেখ করার মতো।
আমরা কবি সাকিব
শাকিলের কাব্যগ্রন্থ দেহ পালিত
সাপ যদি একটু
গভীর মনঃসংযোগ এর
সাথে পর্যবেক্ষণ করি
তবে কিছু কিছু
জায়গায় পুরাণ এর
উল্লেখ লক্ষ্য করতে
পারবো। যা চিরায়ত
লোককাহিনী এবং পৌরাণিক গল্প-কাহিনী থেকে
গড়ে উঠেছে। যেহেতু
তার কাব্য সাপ-কে কেন্দ্র করে
ঘুরেছে, সেহেতু তার
পুরাণ এর ব্যাবহার "সাপ" কেন্দ্রিক হওয়ার
সম্ভাবনাই অধিক। তার
এই কাব্যে "মঙ্গলকাব্যের" প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য
করার মতো যা
অনেকটা ভালো কবিতার
দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে
সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও
তার কবিতায় কিছু
কিছু জায়গায় ঐতিহাসিক পুরাণের ব্যবহারও লক্ষ্য
করার মতো যা
পুরো কবিতাজুড়ে একটি
স্নিগ্ধ গাম্ভীর্য এনেছে।
সেই সাথে, পুরোনো
লোককাহিনী নির্ভর পুরাণের সাথে
বর্তমান পরিস্থিতির সংমিশ্রণ অনেকটা
অভিনব কায়দা বলা
যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কিছু
পঙক্তি উল্লেখ করা
যেতে পারেঃ
[১] "হাজার নদি
পাড়ি দিয়ে মননের
মঞ্চে তারা গেয়ে
ওঠে হৃদয়ের মনসামঙ্গল - 'পৃথিবীর সব
পুরুষ যেন হয়ে
ওঠে লখিন্দর। সব
নারী বেহুলা।'
[২] 'আর
আকাঙ্খা করো সওদাগরের পূজো।
তোমার সকল বাসনা
বন্ধ করে দিবে
আমাদের সাপ।'
[৩] 'কামনার
কানাগলিতে খুঁজে পাবে
না আর কোন
বণিকের জাহাজ। সব
স্থান হয়ে যাবে
মহাখালি।'
[৪] 'ও
বেহুলা, মাঝনদিতে ভেলা
এবার তুমিই ডুবাও!'
[৫] 'সেই
বিষে চুবিয়ে এনেছি
দুটি চকচকে তরবারি। সব
শাসকই তো শোষক।
তাই সব গানগুলো উল্টো
স্রোতে বাইতে থাকে
দুঃস্বপ্নের সিঁড়ি।'
[৬] 'পোড়া
ইট কথা বলা
শিখে গেলে জানাবে
দুর্বোধ্য শিলালিপির ব্যাখ্যা'
এরকম আরও অনেক
পঙক্তি রয়েছে যা
অতীতের সাথে বর্তমানের সুগন্ধি মিশিয়ে
এক অনন্য সৌরভময়
জাগতিক আভা তৈরি
করে রেখেছে।
পাঁচ.
'কবিতা ছাড়া
জীবন, অথবা জীবন
ছাড়া কবিতা' এ
যেন একেবারে অকল্পনীয়। কবিতায়
যদি জীবনের বোধ
সঠিক ভাবে পরিস্ফুটিত না
হয় তবে সেই
অর্থে কবিতা হয়ে
ওঠে না। জীবন
ও কবিতা একে
অপরের সাথে এতোটাই
যুথবদ্ধ হয়ে জড়িয়ে
রয়েছে। একবিংশ শতকের
কবিতাগুলোর দিকে যদি
একটু মগ্ন দৃষ্টিতে তাকানো
যায়, তবে এক
খন্ড বিশাল পোড়ো
ভূমি চোখে পরে।যেখানে এদিক
সেদিক যত্রতত্র এলোমেলোভাবে সমূহ
জীবনের ক্লান্তি, নৈরাশ্যবোধ এবং
আত্মবিরোধ ও অনিকেত
মনোভাবের বীজ ছড়ানো
ছিটনো। এখনে সংঘর্ষ
বাঁধে সভ্যতার সাথে
মানুষের, স্বপ্নের সাথে
প্রেমের, আবার কখনও
আত্মার সাথে জীবনের। এসব
প্রপঞ্চগুলো একে অপরের
সাথে খুব ঘনিষ্ঠরকমে জড়িত।
যা কবিতাকে দিয়েছে
মরূকঠিন নির্দয়তা আবার
কখনও দিয়েছে সুশীতল
ঝরনাধারার মতো উচ্ছ্বসিত ও
ছন্দময় গতিশীলতা।
সেক্ষেত্রে, আমরা কবি
সাকিব শাকিলের কবিতাগুলোর দিকে
যদি একটু পর্যবেক্ষণ দৃষ্টিতে তাকাই
তবে অনুধাবন করতে
পারবো, তার জীবনের
বোধ কতটুকু তীক্ষ্ণ এবং
শানিত। জীবনের পরতে
পরতে যে গ্লানি,
আনন্দ, বেদনা, উল্লাস
লুকিয়ে আছে তা
তার কবিতার প্রত্যেক পঙক্তিতে পাখপাখালির কলকাকলীতে মুখরিত। কাব্যের মুকুর
প্রণয়তাড়িত হয়ে যে
জটিল জীবনের আস্বাদে সংক্ষুব্ধ, তার
উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যেন
কবি শাকিলের কবিতা।
এক্ষেত্রে নিচে কিছু
পঙক্তি দেয়া যেতে
পারেঃ
[১] 'ছন্দের
ভেতরে সন্ধ্যা নেমে
আসে আর হাতে
হাতে হাতগুলো হাতছাড়া হয়ে
যায়'
[২] 'পৃথিবীর সকল
বন্দুকের বুকে বিরাণ
শ্মশান। সেখানেই ঘুমিয়ে আছে
আমাদের পরিচিত অন্ধকার।'
[৩] 'গলাকাটা হাঁসের
মতো একটা রাত
নেমে যাচ্ছে গলা
বেয়ে। কোথাও বৃষ্টি
হচ্ছে তুমুল আর
উঠানে ভিজে যাচ্ছে
প্রশ্নোত্তর হৃদয়।'
[৪] 'একমাত্র পরম
আশেকের এক ও
অদ্বিতীয় সত্তা
যে সত্তা মরমের
আধুলি দিয়ে বিনিময়
করে না কৃত্রিম হাওয়াই
মিঠা'
[৫] 'কফিনের
ভেতরে বড় বেশি
অন্ধকার। বড় বেশি
নিঃসঙ্গতার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি
নামে। দূরের ধু
ধু প্রান্তর থেকে
কে যেন ডেকে
যায় জাহানারার মতোন।'
[৬] 'এ
কেমন ঘোরতর বেদনাবিধুর অন্ধকার? সবগুলো
অন্ধ কুঠরী আমিই
কি রাঙিয়ে নিলাম
আলতার রঙে রঙে?'
[৭] 'সেই
অন্ধপথে সন্ধ্যার ভায়োলিন বাজিয়ে
বাজিয়ে
হাত পা গড়িয়ে
আমিও পেঁকে যাবো
নিশ্চয়!'
[৮] 'পৃথিবীর নরকে
এই তুমিই পুড়ছো
আজ,
অন্য নরকে আগুন
তোমাকে ছোঁবে না'
[৯] 'জীবন
এক ভরা কলস,
প্রেম তার জল
খায় আঁজলা তুলে।
তাইতো কলস থেকে
তুলে আনি জীবনের
দুঃখ।'
[১০] 'মৃদু
হাওয়ায় দুলে ওঠে
পেঁপে পাতা আর
আমরা বান্ধা থাকি
জীবনের ভেতর, জগতের
ভেতর'
এরকম আরও অনেক
পঙক্তি রয়েছে যা
জীবনকে বহু অভিধায়
ব্যাঞ্জনা দিয়েছে। হৃদয়ের
দূর্ভেদ্য প্রাচীরে এঁকে
দিয়েছে শতাব্দীর চিরচেনা অথচ
রক্তিম বর্ণমালার এক
একটা বেদনার্ত অক্ষর।
ভাষা ব্যবহারে সংকোচহীনতা এবং
কবিতায় গদ্য ও
পদ্য ভাষ্যের ব্যবহার এক
অন্য রকম গতিশীলতা এনে
দিয়েছে। এক্ষেত্রে মিতব্যয়ীতা রক্ষার্থে ভাষা
ব্যবহারে এবং চিন্তাধারার মধ্যে
উল্লম্ফনের সৃষ্টি, আপাতদৃষ্টিতে যাকে
মনে হতে পারে
অসম্বন্ধ ও ছন্নছাড়া। এছাড়াও
ব্যাকরণের দিক যদি
বিবেচনা করতে যাই
তবে নামবাচক বিশেষ্য, অব্যয়
এবং ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপের ব্যবহার লক্ষ্য
করার মতো। ব্যঙ্গ, অদ্ভুত
ও বীভৎস রসের
বহুল ব্যাবহারও এক
ধরনের ঘোরের সৃষ্টি
করে। ফলে, কাব্যের অর্থ
এবং আঙ্গিকে এক
ধরনের ধোঁয়াশার সৃষ্টি
হয়। কবিতার প্রত্যেক ভাষ্যে
গদ্য ও পদ্যের
মিশ্রিত আভা থাকলেও
সর্বত্রই গদ্যছন্দের প্রভাব
ছড়িয়ে থাকে।
আমরা সাকিব শাকিলের কবিতায়
এই ধরনের কাব্যকৃতির কিছু
নমুনা পাবো যদি
আমরা গভীর এবং
অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকাতে
পারি। তার কবিতাকর অর্থ
যদি আমরা উদ্ধার
করতে পারি তবে
অনেকটা অন্ধকার ঘরে
অমূল্য রত্ন খুঁজে পাওয়ার
মতো ব্যাপার ঘটতে
পারে। এক্ষেত্রে কিছু
কাব্যাংশ উল্লেখ করা
যেতে পারেঃ
[১] "লাউ ডগার
শরীরে মিশে গেছো
কবে? কবে উড়ে
গেছো হাটখোলার ম্যাজিশিয়ানের হাত
থেকে? দূরে তুমি
উড়ে যাও, ঘুরে
দেখি এপাশে শূন্য।
তবু শূন্যতার ভেতর
অনেক কোলাহল। অনেক
গান বেজে যাচ্ছে
শুন্যতার পথে পথে।
রেড কার্পেটে নেচে
যাচ্ছে কে? তুমি
নাকি তোমার মন?"
[২] 'এক
পা ঠেলে দিয়ে
দু'পায়ে দুলে
উঠি। সঞ্চয়ের ঐশ্বর্য নিয়ে
পালিয়েছে ভবিষ্যতের সময়।
তাইতো অতীতের বিয়ে
দিয়েছি রাতের পাটাতন
খুলে। অরণ্যানী অঞ্চলের পেটে শৈশব ঘুমিয়ে আছে
ভাঙা সাঁকো নিয়ে।"
[৩] 'এই
সেই সম্পর্ক গাছ।
যার তলানী থেকে
উঠে আসে আফিমের
লিকলিকে দানা। পাতাদের সকল
ছায়া মেতে উঠে
কালো কালো অন্ধকারে।'
[৪] 'সুপুষ্ট স্তনের
ভেতরে লালন করি
সেই প্রেমময় সাপ।
নাভিতে ছেড়ে দিয়ে
করি সৌহার্দ্যের শিৎকার।'
[৫] 'বেদেনীর বুকের
দুধে দেখেছিলাম জীবনের
মধু। লালায়িত শরীরের
স্তনে-উজানে উঠেছে
সিথানের বিষ, ভাটিতে
নেমে গেছে অন্তবর্তী অপেক্ষা।'
[৬] 'সেই
বাস্তুচ্যুত খুপরি ঘরে
শিখেছিলাম রমণের কামকলা। তাইতো
বাৎস্যায়নের বয়স বেড়ে
গেছে আজ, আর
ঝুলে পড়েছে সেই
প্রেমময় স্তন।'
[৭] 'এভাবে
শর্ত খুঁড়ে গর্তে
ঢুকে পড়ে ভেতর
বাড়ির আয়নায়। আয়না
আয়না দীর্ঘ হয়,
দীর্ঘ হয় কঠিন
কাচের নদি।'
এরকম আরও অদ্ভুত
অথচ গভীর অর্থপূর্ণ উপমা
ও উৎপ্রেক্ষা কাব্যে
নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের দাবী
রাখে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এসব
কাব্যাংশ অর্থহীন এবং
অসংলগ্ন মনে হলেও
তা অর্থে এবং
গভীরতায় এক অনন্য
মাত্রায় আসীন হয়ে
থাকে।
সাত.
প্রকৃতপক্ষে, কাব্যের সমালোচনা এবং পর্যবেক্ষণ করা অনেক দুরূহ কাজগুলোর মাঝে অন্যতম একটি । যদিও সময়ক্ষেত্রে তা করতে হয় পাঠকের হৃদয়ঙ্গমের সুবিধার্থে যা অনেকক্ষেত্রে কাব্য বহির্ভূত কিছু কিছু বিষয়ের অবতারণা করে, কাব্যের যথাযথ মূল্যায়ন না করেই। এতে কবি এবং কবিতা বিষম রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। এমনকি এতে কাব্যের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার আঙ্গিক এবং অবয়ব এতোই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে যে কাব্যের লক্ষ্মী অনেক সময় ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এটা মূলত যুগেরই প্রতিচ্ছবি বলা যেতে পারে। যে যুগের জীবনপ্রণালি যতো জটিল, কাব্যের মুকুর ততই নিরস এবং কংক্রিটের মতো অসচ্ছ। আমি মূলতঃ সাকিব সাকিলের কবিতার কিছু কিছু দিক আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র, আবার কিছু কিছু দিক হয়তো অধরাই থেকে গেল। আমার যেটুকু অক্ষমতা থেকে গেল, পরবর্তীকালে হয়তো আমার চেয়েও অধিকতর পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার কবিতা বিশ্লেষণ করবে সেই আশাবাদ ব্যাক্ত করছি। কাব্যের ফুলে ও ফসলে এই আনন্দহীন জগতটা আবারও একদিন নতুন করে প্রস্ফুটিত হবে এই সম্ভাবনা অন্তত জাগ্রত হোক। এই পৃথিবীতে নতুন নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠুক, যার জন্যে কিছুটাকাল হলেও বেঁচে থাকার আশা বুকে বাসা বেঁধে থাকুক। সর্বোপরি, কবিতার জয় হোক।
0 Comments