বাংলা কাব্য সাহিত্যে সমাজ ব্যবস্হার অসংগতি, স্বার্থান্বেষী শ্রম অপহারক সমাজপতি,প্রবল অভিজাতদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ ব্যবহৃত ধর্ম ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধোয়াসা- পূর্ণ অস্পষ্ট সুর ধ্বণিত হয়েছে বাংলা কাব্যের প্রারম্ভিক লিখিত রূপ চর্যাপদের কবিদের কন্ঠে । মধ্যযুগের গীতি কবিগণের শিরোভূষণ চন্ডিদাসের-
" শুনরে মানুষ ভাই-
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই" ।
প্রচলিত ধারণা বিশ্বাসের মূলে স্পষ্ট কুঠারাঘাত । মধ্যযুগেরই কাহিনী কাব্য রচয়িতা মুসলিম কবি আব্দুল হাকিম অভিজাত বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তার-
" যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ।
দেশী ভাষ বিদ্যা যার মনে নাই জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায় ।"
এরপর আসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিক যুগ,মাইকেল মধূসূদন দত্ত যার মূল স্হপতি । কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত বলেন - " মাইকেল শুধু ম্রিয়মান কাব্যকে জাগিয়ে তুলে ঝিঁমিয়ে পড়েননি,বাঙালি কবিকে তস্করজাতওয়ালাদের দল থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন তিনি।"( কুলায় ও কাপুরুষ)
আধুনিক বাংলা ভাষার কবি ও কবিতায় বিদ্রোহের সরব ডঙ্কায় কাঠি নাড়েন মধূসূদন তার যুগ প্রবর্তনকারী রচনা সমুহে । আজ নিশ্চয়ই কেউ বলবেন না যে, মধুসূদনের বিদ্রোহ ছিল বাংলা কাব্য জগতে অশুভ " অনিষ্টাচরণ " । অথচ মধুসূদন পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন বাংলা ভাষার কোষগ্রন্থ প্রণেতারা বিদ্রোহের অর্থ করেছেন-" অনিষ্টাচরণ,শত্রুতা,বিদ্বেষ " । বিদ্রোহের ভাষ্য দিয়েছেন- অনিষ্টাচরণকারী,বিরোধী ইত্যাদি বলে ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের হস্তে তুমুল আলোাড়নে অগ্নি বীণার উন্মাতাল ধ্বনি আলোড়িত করলো- বাংলার আকাশ বাতাস, কন্ঠে তার বিষের বাঁশি কাঙ্খিত প্রলয় ঝংকার- সংঘবদ্ধ সর্বহারা আপোষহীন জয়গাঁথা, ভাঙ্গার গান - এর স্ফর্তিতে মনুষ্যত্বের নব উত্থানের উদাত্ত বাণী প্রচীনপন্থী সংস্কারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে বাধ্য করলো তাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপপ্রচার মূলক ক্রিয়া কলাপ হতে বিরত হতে । মানব জীবনের জন্য ক্ষতিকর বিষয়সমূহ- তা'ধর্মের নামে, নৈতিকতার নামে, আদর্শের নামে যত মহিমাযুক্ত করেই প্রকাশ তথা চর্চা করা হোক না কেন - তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অনিষ্টাচরণ নয়, নয় শত্রুুতা কিম্বা তথাকথিত বিদ্বেষ । বরং এই বিদ্রোহ প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার,যেমন প্রতিটি মানুষ সূর্যের আলো এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর জন্মগত অধিকার স্বত্ববান ।
বাংলা ভাষা,বাংলা কাব্য, বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীরা এই নতুন সঙ্গা সংযোজনের মহান কৃতিত্ব কাজী নজরুল ইসলামের ।
বাংলা সাহিত্যের পূর্বাপর মূখ্যধারা বিদ্রোহের খাতে প্রবাহিত যার গতিময় পরিণতি - নজরুল ইসলসমে।তদুপরি শাণিত যুক্তিগ্রাহ্য বিদ্রোহী নজরুলের আবির্ভাবকে অনিবার্য করে তুলেছিল উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসকশ্রণীর ভারতীয় মেহনতি জনগোষ্ঠির উপর নির্মম নিষ্ঠুর শোষণ - পীড়ন ,তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সন্ত্রাসবাদী কার্য কলাপ,বিশ্ব জ্ঞান ভান্ডার মার্কস- এ্যাঙ্গেলসের নবতর চিন্তা চেতনার সংযোজন এবং সবোর্পরি মহান রুশ বিপ্লব যার দুনিয়া কাঁপানো ঢেউয়ের দোলা বৃটিশ- ভারতকেও টাল মাতাল করে দিয়েছিল ।
" আজাদ আত্মা ! আজাদ আত্মা ! সাড়া দাও,দাও সাড়া
এই গোলামীর জিন্জির ধরে ভীমবেগে দাও নাড়া ।
হে চির অরুন- তরুণ ,তুমি কি বুঝিতে পারোনি আজো
ইঙ্গিতে তুমি বৃদ্ধ সিন্দাবাদের বাহন সাজো!
ঘরে ঘরে তব লান্ছিতা মাতা ভগ্নিরা চেয়ে আছে
তাদের লজ্জানিবারন শক্তি আছে তোমাদেরই কাছে।"
( নতুন চাঁদ,আজাদ)
" আজ চারিদিক হতে ধনিক বনিক শোষণকারীর জাত
( ও ভাই) জোঁকের মতন শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত।"
( কৃষাণের গান - সর্বহারা)
" যত শ্রমিক শুষে নিঙড়ে প্রজা
রাজা উজির মারছে মজা ।
আমরা মরি বয়ে তাদের বোঝা রে
এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল
ধর হাতুড়ি,তোল কাধে শাবল ।"
( শ্রমিকের দল- সর্বহারা)
বিশ্ব পুঁজিবাদ তথা ধনবাদী শোষণকে মার্কস দেখেছেন- " নেকেড, শেমলেস,ডাইরেক্ট ব্রুটাস এক্সপ্লয়টেশন " রূপে।
নজরুল বলেন-
" রাজার প্রসাদ উঠেছে প্রজার জমাট রক্ত ইটে
ডাকু ধনুকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে।"
( চোর ডাকাত - সর্বহারা)
" পরের মুলুক লুট করে খায়
ডাকাত তারা ডাকাত ।"
( কামাল পাশা- অগ্নি বীনার)
" তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙ্গা ?
ঠুলি খুলে দেখ,প্রতি ইটে আছে লিখা ।"
( কুলি মজুৃর- সর্বহারা)
সনাতন ধর্মের নামে কপালের লিখন বলে সবকিছুকে যারা ধৈর্য্যরে সাথে মুখ বুজে সহ্য করে যেতে উপদেশ দেয়,মৃত্যু পরবর্তী জীবনে (!) মহা সুখের সংবাদ বিলায় , তাদের দৃষ্টিতে কবির এহেন উচ্চারণ অবশ্যই " অনিষ্ঠাচরণ " ।
কিন্ত্তু এদের কাল শেষ হয়েছে,' সাম্যবাদের' অপ্রতিহত উদ্ভব মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে রক্ষণশীল মুখোশ আটা শোষক- শাসক শ্রেণির । নির্যাতিতদের জাতি নাই, ধর্ম নাই।তাদের এক পরিচয়- তারা মানুষ।তাদের স্বর্গ দূরে অন্য কোথাও।
" বন্ধু এখানে রাজা- প্রজা নাই,নাই দরিদ্র- ধনী
হেথা পায় নাকো কেহ খুদ - ঘাটী,কেহ দুধ সর ননী।
এই সে স্বর্গ,এই সে বেহেশত এখানে বিভেদ নাই
যত হাতাহাতি হাতে হাতে রেখে মিলিয়াছি ভাই ভাই।
নাইকো এখানে ধর্মের ভেদ,শাস্ত্রের কোলাহল
পাদরী পুরুত,মোল্লা ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল ।"
( সাম্য - সর্বহারা)
কবি আরো বলেন,-
" কাটায়ে উঠেছি ধর্ম আফিম নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম যাজকী পেশা ।
বাঙ্গি মন্দির,ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত।
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা" ।
( প্রলয় শিখা- বিংশ শতাব্দী )
দেশের সাধারণ মানুষ উৎপাদক শ্রেণীর জন্য ভজনালয়ের হ্রেষা ধ্বনির বিপরীত গান গাইতে হবে, যে গান ভীত সন্ত্রস্ত স্তব্ধ করে দিবে শ্রণী বিভক্ত সমাজ রাষ্ট্র কর্ণধর ও তাদের পদলেহী স্তাবক দল যারা শোষণ নিপীড়নের ষ্টীম রোলার চালিয়ে উৎপাদক মানুষকে মানবেতর পরিবেশে নিক্ষেপ করেছে ।
" তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর,মুটে ও কুলি
তোমাদের বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি ।
তারাই মানুষ ,তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান
তাদের ব্যথিত বক্ষে পস ফেলে আসে নব উহূথান ।
সিক্ত যাদের সারা দেহ মন মাটির মমতা রসে
এই ধরণির তরণীর হাল রবে তাদের বশে ।"
( কুলি মজুৃর- সর্বহারা)
শোষক শ্রেণী কর্তৃক মানবেতর পরিবেশে নিক্ষিপ্ত সমাজ সভ্যতার প্রকৃত পিলসুজ সাধারণ গণমানুষকে
" প্রলয় পারাবার" পার হওয়ার জন্য নির্ভীক কন্ঠে গান ধরেছেন কবি-
" মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে মাটির বুকে চল
শক্ত মাটির ঘায়ে হউক রক্ত পদতল ।
প্রলয় পথিক চলবি ফিরি
ধরণি পাহাড় কানন গিরি
নাচছে সিন্ধু জল
চলরে জলের যাত্রি এবার মাটির বুকে চল।"
( সর্বহারা)
বাংলা সাহিত্যে,বাংলা কাব্যে নজরুল ইসলামের উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল বিদ্রোহ নবতর যুগের জন্ম দিয়েছে। কাব্য সাহিত্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে এবং নজরুল প্রবর্তিত বিদ্রোহের প্রয়োগিক প্রয়োজনীয়তা বিপুল বিক্রমে অনুশীলনের অপেক্ষায় প্রতীয়মান আমাদের বাংলার সমাজ- দেহ ।
0 Comments