সাদা পালক খসে গেলে পাখিরা ভ্রমণ ভুলে যায় || অক্ষর প্রবাল



০১.
চোখের পুকুরে ডুব দেবার সায়াহ্নকাল যখন
উড়ে আসে নতুন চিল আগামীর অভিযোজনে।
আমি নাভিতে বসে থাকি আরেকটা রাতের নামে-
তোমার বুকের উপরে সবুজ ঘাসের ডগায় নেভানল পাউডার নিয়ে।
বিচ্ছেদ এক প্রকার বজ্র
মনের মধ্যে মাটি ফেটে যায় প্রচন্ড শব্দে
আর গণকবরের পাশে আরেকটি মন ঘুমিয়ে যায়
এক গ্রাম গোলাপী নিস্তব্ধতা নিয়ে।
০২.
রাতের পিঠে রাত বসে থাকে অসহ্য চিলের বিক্ষোভ নিয়ে।
বরফের হাড় আকাশে উড়ে যায়
ফেলে যায় সফেদ রাংতা
পৃথিবীর কোণে তাই আজ কুড়িয়ে নিচ্ছি ক্ষুধার নিজস্ব নাম।
এই ক্রোধ ভারাক্রান্ত দেশে কাগজের প্রলাপ বেশি দামী।
সংলাপ বাকি থেকে গেলে পকেটে হাত ঢুকে যায়
আমার এসব বলার সময় আসে নি
অথচ পাঁজাখানেক দৃশ্য সেঁধিয়ে যাচ্ছে চোখে।
সেদিন দূর্বার মাথায় নগ্ন দৃষ্টির হাত বেলাশেষে উবে গ্যাছে
সোনালী সানগ্লাস পরে হেঁটে গ্যাছে চারকোল আঁকা পথে-
ছড়িয়ে বিচ্ছেদ-রঙ অনাদায়ী পুকুরের গভীরে।

০৩.
সময়ের ঘন্টা বেজে গেলে মাছেরা কেঁদে ওঠে-
জলের অতলে হারিয়ে যায় চোখ।
চোখ হারিয়ে গেলে মানুষ বাদুড় হয়ে যেত
অন্ধকারের তলায় খুঁজে নিতো জন্মান্তরের পারদ।
এ শহরে ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে হতাশায়
অথচ মাথা ঘষে ঘষে বিচলিত নাবিকগণ সেখানে দেখছে অর্বাক বিস্ফোরণ-
উন্মাতাল সৃষ্টির শ্লোক।
গুটিকয়েক গ্রীষ্মরাত ফুরিয়ে গেলে কচ্ছপ মরে যায় শোকে।
পাখিরা ফিরে যায় নীড়ে একান্ত সাংসারিক শব্দের খোঁজে।
ইদানীং শব্দের বাজারে হারিয়ে যাচ্ছে লোভাতুর মানুষ
তাই পৃথিবীর ডানায় চড়ে বারবার ঘুরে আসি চড়ুইয়ের প্রত্যাবর্তন শেষে।
 
০৪.
চালক হারিয়ে গেলে ধোঁয়াগুলো খুঁজে নেয় বাতাস-
রঙহীন মায়ার চাদরে সুতোর অক্ষরে এটাই স্বপ্ন স্বপ্ন খেলা।
হার জিত আছে বলেই জুয়াও এক প্রকার খেলা
আমি ভাবি- পঁচিশ জন্ম হেঁটে এসে বুঝলাম জীবন জুয়ার সমার্থক।
ফর্দের আড়ালে তবু আমরা হিসেব কষি।
(মূলতঃ ঈশ্বরই আমাদের শিখিয়েছেন হিসাব সংক্রান্ত সমুদয় সূত্র।)
কলমের কালি ফুরিয়ে গেলে বৃক্ষের শাখায় তুলে দেই কপালের রেখা।
ইদানীং জীবনের ভাঁজ খুলতে গেলে বেরিয়ে আসে অভাবের পঁচা পঁচা গন্ধ।

০৫
মিনাক্ষী আমাকে সমুদয় পাখির সূত্রে নামতা শেখাতে চায়-
অবহেলার সুতো কাটা ঘুড়ির ভ্রমণ বিষয়ক পদ্যও
শিখেয়েছে হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ানোর ফাঁকে।
ঘুমন্ত রাতের পিঠে বর্শি ফুটাতে পারি নি ঠিকই
তবু আকাশের নিচে রোদের সরকারি নৃত্য দেখেছি।
মিনাক্ষী শীতের আড়ালে অনিয়মিত রোদ কুড়াতো
ঝুড়ি ভরে আমাকে উপহার দিতো নিয়মের সুর।
আমি কখনো নিয়ম গুণতে শিখি নি
আলেয়ার ফাঁদে মেপেছি অভাবী পায়ের দৈর্ঘ্য।
তবু নিয়ম করে মীনাক্ষী নিলামে কিনে নেয় দুঃখ
আর আমি বাটখারা সরিয়ে সরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি প্রেমাসক্ত নগরীর বুকে।

০৬.
ছাতা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে বৃষ্টির নাম মুখস্থ করেছিলাম সংশয়ে।
পৃথিবীর আদ্যপান্ত ডায়েরিতে এঁকেছিলাম প্রেমের জাহ্নবী সুর।
প্রলাপ করতে করতে ডুব দিয়ে দেখলাম জীবন এক প্রকার মানসিক ধাঁধা
জটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নীলচে পাখার কয়েক গুচ্ছ শ্লোক
তবু উড়তে গেলেই পা টেনে ধরে কৃষ্ণগহ্বরের যাযাবর ভৃত্য।
আমি কখনো বৃক্ষ হতে চাই নি
যদিও পাখিদের ডাক পারি নি এড়াতে।
০৭.
যূথবদ্ধ শালিখের রসালাপ পড়ে বুঝতে পেরেছি পৃথিবী একটা রসালো হাড়ি।
মানুষ আজন্ম মূর্খ রস বিষয়ক সমস্ত পদ্যে।
তাই হাঁটতে হাঁটতে কেটে যায় আমাদের অজস্র পাখিজন্ম
অথচ পূর্বপুরুষ প্রদত্ত পাখা মেলার আগেই ফুরিয়ে যায় অগ্রন্থিত রসায়ন দৃশ্য।

০৮.
রাস্তার মাথা খুঁজে পেলে আমি রাস্তাকেই গুরু বলে মানতাম;
শিরায় শিরায় অভাব লুকিয়ে আয়না হবার প্রথম প্রতিচ্ছবি।
ঈশ্বর, আমাকে বলে দেবেন কয়টা জুতা থেকে জীবন বেরোলে
আমি ঐ রাস্তার মাথা খুঁজে পেতাম?
পৃথিবীর ফুটনোটে জীবনের ঘুম সংক্রান্ত সামরিক তত্ত্ব    লেখবার জন্য
আমি সেই রাস্তায় বেছে নিতে চাই।
যেখানে থাকবে কুকুর ও মানবিক আলাপ
বস্তু এবং তার দৈর্ঘ্যের তামাটে অনুশাসন
আর জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি কিছু নিস্প্রভ সংলাপ।
 
০৯.
এখানে বসন্তের আগে দূর থেকে ছুটে আসে এক ঝাঁক জোনাক
জেগে ওঠে রোডম্যাপ সমস্ত বুকে।
কাগজভর্তি মাঠে বউছি খেলায় হারিয়ে যাওয়া বিকেলে
আমি শুনতে পাই ফুল শুকিয়ে যাওয়ার মন্ত্র।
বাতাসের প্রাণ ভেসে আসে আয়াতের মতো
গলায় ঝুলিয়ে রাখা শব্দের বীজ নিয়ে
ঘুরে বেড়ায় উদ্ভট হ্যালুসিনেট দৃশ্যে।
অ-ঘ্রাণের পুকুরে ভেসে ওঠে দৃশ্যান্তরের তর্জমা
তবু গাছের ছায়ায় ছড়িয়ে থাকে মরিচপোঁড়া দিনের নৈমিত্তিক চালচিত্র।

১০.
হাঁড়ির ভেতর থেকে তুলে আনছি সেদিনের সাদাকালো কপোতের মাথা
খোলাচিঠির অভাবে ডুবে ছিলো যা অন্ধ তারার স্রোতে।
এখন স্মৃতির আঁচল তুলে উঁকি দেয় মখমলে ডানা।
উড়ে যাই আমি, ডুবে যাই ভুলে বেসামাল রোদ।
পৃথিবীর ব্যস্ত নিরিখে চোখ রেখে হেঁটে গেছে যে ক্লান্ত পথিক
গায়ে তার লাল লাল ছোপ।
আমি উদ্ভ্রান্ত শালিখ
ফসলের নলায় তুলে রাখি সংসার।
দিনের আড়ালে হারিয়েছে কত শত লোক
কত শত ঘুম পুড়ে গেছে রেটিনার মুখে।
অথচ হিসেবের ঘরে ধান এঁকে শেষ হয় শালিখের ঘুম।

১১.
যখন সাদা পালক ছিলো তখন লাল বাস থেকে হাত বাড়াতো যৌবন
আমি বারবার ধরতে গিয়ে নেমে যেতাম বিষন্ন বায়ুতে
প্রতিটি ফুলের পাপড়ি উল্টিয়ে পড়ে নিতাম ঘৃণাবিষয়ক প্যাপিরাস মিথ।
কখনো পেয়ে যেতাম অয়নান্তিকা, কখনো অ্যাফ্রোদিতি আবার কখনো
মিনাক্ষীর নার্সিসাস ঘুম
তখন জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ঝুলে যেতাম রিকশার প্যাডেলে
কী দ্রুত ঘুরে যেতো পৃথিবী!
চোখ খুলে দেখতাম কাকভর্তি শহরের বুকে হৃদয়ের কোনো হাসপাতাল নেই
অথচ হৃদয়ভর্তি মানুষ নিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি শ্মশানের পথে।

Post a Comment

0 Comments