জীবনানন্দ দাশ একজন ক্ষতিকর কবি
জীবনানন্দ দাশ একজন ক্ষতিকর কবি কারণ তিনি স্বপ্ন থেকে পুরোপুরি জেগে উঠেছিলেন,ক্ষতিকর কারণ এই সভ্যতাকে আফ্রিকার জঙ্গলের চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘোষণা করেছেন। ক্ষতিকর, কারণ আধুনিক পৃথিবীতে বুর্জোয়া জীবনপদ্ধতিকে শতশত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর বলে উপলব্ধি করেছিলেন।
তিনি ক্ষতিকর কারণ আমাদের ভালবাসার অন্তরালে স্বার্থের প্রেতকে তিনি নাচতে দেখেছেন।তিনি ক্ষতিকর, কারণ সভ্যতার ঘুমপাড়ানি মদ তিনি খেতে অস্বীকার করেছেন। সৃষ্টির মনের কথা ভালবাসা নয়-দ্বেষ, এই ভয়াবহ আবিষ্কার যে কবি করেছেন, আত্মসন্ধানে বিমুখ,আত্নরক্ষায় ব্যস্ত মানুষ তাকে ক্ষতিকর না ভেবে পারে না। 'বিপ্লব সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয় শুধু ,কোন কোন ক্ষেত্রে গোটা পরিপ্রেক্ষিতের মুখে দাঁড়িয়ে এ বিপ্লব পূর্নতর সমীকরণের চেষ্টায় অর্থাৎ রহস্যের নতুনতর অর্থ সন্ধানে ব্যস্ত।
কাজেই এসব কবিতার জীবন দর্শন রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাবোধের চেয়ে অন্য এক জিনিস।'
২.
জীবনানন্দ দাশ একজন ক্ষতিকর কবি
পঞ্চাশ দশকের কবিদের অনেকে জীবনানন্দের কবিতার এই রোমান্টিক অংশ থেকেই প্রেরণা নিয়েছেন। এদের মধ্য শক্তি চট্রোপাধায়কে আমরা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসাবে মনে রাখি।শক্তি প্রচুর লিখেছেন,আরও বেশি হুল্লোড় করেছেন,তাকে নিয়ে নিত্যনতুন গল্পগাথা তৈরী হয়েছে।আর লিখে পার্থিব পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিয়েছেন। কিন্ত চেতনার কোন নতুন বলয় খুঁজে না পেয়ে রোমান্টিক গাড্ডায় পড়ে গিয়েছেন। জীবনানন্দ ভাষার মোহে পড়ে ডুবেছেন। জীবানন্দের ভাষা বিনয় মজুমদারকেও গিলে খেয়েছে।অন্যদিকে এই সময়ের আরেকজন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জীবনানন্দের ভাষাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন কিন্ত দুঃখের বিষয়, চেতনার নতুন কোন দিকমুখ ধরতে না পেরে শহুরে যুবকের হাহুতাশ বা নারীর প্রেম পাবার প্রয়াসের মধ্যেই তার আধুনিকতার উদ্যম শেষ হয়ে যায়।পঞ্চাশের কবিরা বাংলা আধুনিক কবিতার শেষ কবিদল। আধুনিকতা প্রতিষ্ঠানের সেবাদাসী হওয়ায় এই কবিদলের অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারের মালা গলায় নিয়ে ঘুরছেন। এসব তারা বেশ বুক ফুলিয়েই করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক চেতনার কিছু অংশ যে জীবনানন্দে নেই তা নয়,তবে প্রতিষ্ঠান জীবনানন্দের মধ্য আরো বিপদজনক কিছু দেখতে পায়; এই কারণে জীবনানন্দ একজন বড় কবি মেনেও,প্রাতিষ্ঠানিক ধ্যানধারণা বলে,রবীন্দ্রনাথের বিস্তার আরও বেশি। প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী চক্র রবীন্দ্রনাথকেই তাদের পাথেয় বলে মনে করে। প্রতিষ্ঠানের দেওয়া সবরকম সুবিধা ভোগ করব আবার কবিতার যথার্থ পথটিও পেয়ে যাব,অন্তত বাংলা সাহিত্য ৬০ দশকের পর থেকে এটা হওয়া অসম্ভব।
শৈলেশ্বর ঘোষ
বর্ণ পরিচয় পত্রিকা ১৯৮৯
0 Comments