দাউদ হায়দারের কবিতা




দাউদ হায়দার  স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি। তার লিখিত ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়' নামে একটি কবিতার জন্য তিনি তৎকালীন ধর্মীয় মৌলবাদীদের রোষানলে পরেন। 
তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার দাউদ হায়দারকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। 
 ১৯৭৩ সালে কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১শে মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে 
তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে দেশ থেকে নির্বাসনের পর বর্তমানে জার্মানীতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।

দাউদ হায়দারের কবিতা

তোমার কথা

মাঝে মাঝে তোমার কথা ভাবি
আকাশে জমেছে মেঘ, বাতাসে বৃষ্টির গান
রাত্তির বড়ো দীর্ঘ; কিছুতেই
ঘুম আর আসছে না। একবার এপাশ, একবার ওপাশ,আর
বিশ্বচরাচর জুড়ে নিথর স্তব্ধতা।

মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেণ্টের চূড়োয় উঠে

চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি :
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।

২৫/১০/৮৩


  উত্তর চাই, জাহিদ

১.

যত দিন যাচ্ছে, কেবলি
মুখোশ পাল্টে নিচ্ছি, ক্রমাগত
পাল্টে যাচ্ছে নামগুলো—মনে হয়, আমি আর সেই আগের আমি নেই;দ্রুত যাচ্ছি ধসে,কোথায় যাচ্ছি; তাও অজানা।জাহিদ, শুধু তোমার কিংবা আমার কথা নয়; আমি
গোটা দেশের কথাই বলতে চাই।
দেশের প্রসঙ্গেই আমার বারবার মনে হয়

কী করে একটি জাতি
মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেল।

২.

যারা গনতন্ত্রের কথা বলছেন,আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না
দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে,মানুষের বাঁচবার অধিকার ও স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে
একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে
কী করে গণতন্ত্র সম্ভব?–
অবশ্য, প্লেটোর কথাটাও আমি ভুলছি না :

মিথ্যা বলার অধিকার কেবল শাসকের, আর
সবই রাজকীয় মিথ্যা।”

জাহিদ, নিশ্চয় তোমার রিপাবলিকের
কথাগুলো মনে আছে :

শাসিতের পক্ষে শাসকের মান্য করা কি ধর্ম”?
ভেবে দ্যাখো : “টেকোমাথা আর সচুল মাথার কাজ
সত্যিই কি ভিন্ন, কখনো হয়েছে?তোমার দক্ষতার সাথে, আমার

বিনিময় চলে না বন্ধু; কিন্তু,অভিভাবকদের বিবাহ উৎসবে আজ
পুত্রকন্যাই অতিথি!”

৩.

জাহিদ, তোমার চারপাশে লক্ষ মানুষের
ভিড়; দ্যাখো
প্রত্যেকে তোমার দেশভাই, প্রত্যেকে
প্রতিকার চায়, প্রত্যেকে তোমার
মুখের দিকে চেয়ে আছে,–
কেননা, এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তুমিই
অংশ নিয়েছিলে;–মনে পড়ে,সেই একাত্তরে তোমাকে

'অর্জুন’ বলে ডাকতুম।
জাহিদ, আমি তো ভাবতেই পারি না
সেই দৃশ্য :
ষাট হাজার যাদবরমণীকে
লুঠ করে নিচ্ছে দস্যুদল,ধর্ষণ করছে উথালপাতাল; অথচ

অর্জুন চেয়ে দেখছেন,হাতে তাঁর গাণ্ডীব;তিনি অসহায়!
–তবে কি গোটা দেশ ক্লীবে পরিণত?


জাহিদ, আমি কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইছি—যে মুক্তিযোদ্ধার দল, রণাঙ্গনে রক্তকরবী ফুটিয়ে
দেশের স্বাধীনতা এনেছিল
তারা আজ কী করে দর্শক, বৃহন্নলা; বলো তো!
৩/১০/৮৩


নিরন্ন মানুষের দেশে

[অত্যাচারের অমোঘ নিয়মে সুখী অসুখীর বিচ্ছেদ ভেঙে কবে যে সবাই বাঁচবে।
হেমন্ত/বিষ্ণুদে

–আমিও ভাবি তাই; দিনান্তে দিগন্তে বাজে
নরবলী মড়ক-সঙ্গীক। নিরন্ন মানুষের দেশে মাঝে মাঝে
তাই মৃত্যুঞ্জয়ী হতে চাই। যদিও, পিতৃকালের শানিত তরবারী নাই
তবুও পথে পথে ঘুরি; যদিও প্রাণের সীমানায় পাই

ঐশীর সীমা, অকাল বোধনে।
আমিও ভাই তাই, নিরন্ন মানুষের দেশে
অত্যাচারের অমোঘ নিয়মে সুখী, আমি-তুমি, নানা পরিবেশে
রাজণ্য অত্যাচারে, নানা ধর্মঘটে, কখনোবা
মারী ও বন্যাতে। দিনে দিনে শুধু জনসভা
এদেশের আনাচে কানাচে; অথচ অসুখী বিচ্ছেদ ভেঙে মনে-

প্রাণে বাঁচা যে কঠিন দায়; আমাদের নবজীবনের উজ্জীবনে।

৭/২/৮৩

স্বাধীনতা মৃত্যুর চেয়ে বড়ো

বুঝলে জাহিদ, দিনকাল যা পড়েছে
এখন বেঁচে থাকাটাই দায়।
প্রত্যেকদিন সকালে উঠে দেখি
ঘাড়ে মাথা আছে কী নেই
চোখ দু’টো দেখছে, না অন্ধ
কানে শুনছি, না বধির

চুলগুলো কালো, না শাদা
কিছুই বুঝতে পারি না।
ডাইনে বললে বামে
বামে বললে ডাইনে
চলবো; এমন সাহসও আর নেই।

অথচ দ্যাখো
এই আমরাই একদিন
ভাষার আন্দোলনে, ঊনসত্তরের গণুভ্যুত্থানে
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে
শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তখন,আমাদের কাছে

মৃত্যুই ছিল জীবনের স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা ছিল মৃত্যুর চেয়ে বড়ো।
আর সেই স্বাধীনতা পাবার জন্যে
কী কাণ্ডই না করেছি।
অথচ দ্যাখো
একটি দশক যেতে না যেতেই
স্বাধীনতার কি হাল
দেশের কী অবস্থা

খাদ্য বাসস্থান এমন কী জীবন ধারণের নিরাপত্তাও
আজ অনিশ্চিত।
–আজ, শত্রু মানে পাকিস্তান চীন আমেরিকা নয়
শত্রু মানে আমরাই দেশবাসী, আজ
স্বাধীনতা মানে-
কতিপয় মানুষের হাতে
অর্থ ও শাসন ক্ষমতা।


তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের

তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের । নবারুণ ভট্টাচার্য

অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।
অনন্তকাল থাকবে ক্ষুধা

দারিদ্র ও মৃত্যু শাপ
মশাল হাতে নাচবে প্রেত
বন্যা, খরা, দুর্বিপাক।
অনাথ শিশু, চক্ষু বসা
চলছে চলবে গুরুর দশা
চলছে চলবে গুরুর দশা
মরণ, মারণ—চলবে তাই।
জুলবে কুমির, বাঘের চোখ
আমিষ গাছের বিষম ফল
লতাবে সাপ কাটায় কাটায়
পচা নদীর বদ্ধ জল।
অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।


নগ্নতাই আমার সৌন্দৰ্য

পুনর্বার ফিরে যাবো মধ্যরজনীতে আমি ও আমার সকল সুন্দরতম শত্রু
ফিরে যাবো সেই রমণীর কাছে; যার নিবাসে নিরপরাধ প্রেম
লুকিয়ে থাকে
সগৌরবে তুলে ধরে বাহু
ভাবনার একান্ত নক্সী ভায়োলীন
সিম্ফনির মতো বাজতে থাকে একলা বাতাসে–
আমরা তাকে ডেকে এনে
জ্যোৎস্নাহীন জ্যোৎস্নায় হত্যা করবো
খুলে নেব সমস্ত ভূষণ প্রেমের মাদুলী
শুধু রক্ষা করবো তাঁর একমাত্র প্রিয় গাঁথা!
পুনর্বার ফিরে যাবো; ফিরে যাবে সুশোভনাকে সঙ্গে নিয়েই
ফিরে যাবো
ফেলে যাবো রজনীগন্ধার বনে শাড়ি ব্লাউজ ও গোপন অন্তর্বাস
নতজানু হয়ে অবলোকন করব হৃদয়; হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা

সৌন্দর্য্যে এবং নগ্নতা
তোমরা সবাই চলে গেলে; চলে গেলে হে আমার সুন্দর শত্রুরা
আমি সুশোভনাকে তুলে নিয়ে ফুলের মতে সাজিয়ে রাখবো–সাজাবো আমার গোলাপ-টেবিলে!
৮/১/৭৩


একদিন কেউ কাউকে চিনবে না  
(মেহবুবা শিরীন-কে)

সবই চলে যায় সবই চলে যাবে একদিন
তবু কেউ কারও মুখ দেখবোনা সঠিক
অস্পষ্ট ভালবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্ততঃ
আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নীলিমায়
চোখে চোখে চোখ রাখলে কেউ কাউকে চিনবো না
ভুল কোরে পাশাপাশি হেঁটে গেলে কেউ কাউকে দেখবো না –একদিন শরীরে শরীরে মিশে যাবো
একদিন জীবন সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো
একদিন মিছিল থেকে চলে যাবো মরণ ভবনে

একদিন ডেকে ডেকে চলে যাবে অলীক ঠিকানায়
একদিন নির্ভুল নিয়মে দাঁড়াবো মুখোমুখী
একদিন আমি তুমি চলে যাবো কালের আঙিনায়
একদিন তবু কেউ কাউকে চিনবো না!

৭/৩/৭০

Post a Comment

0 Comments