সাইকেল
সাকিব শাকিল
দরিদ্রের দায়চাপানো সংসারের প্রতিটা প্রতিচ্ছবি লেগে আছে এ ঘরের ঘুণে ধরা পুরোনো কড়িকাঠের ফ্রেমে।
ছেড়া মশারি,তেলের অভাবে নিভুমান একটা হারিকেন,ঘরজুড়ে মাকড়সা জালের সয়লাভ।
পুরোনো একটা টেবিলে মোম জ্বালিয়ে সন্ধ্যায় পড়তে বসে অপু।বাংলা বইয়ের পদ্য অংশে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মভূমি কবিতাটি সুর করে পড়তে থাকে সে।
বাইরের উঠানে ছাওয়াহীন রান্নাঘরে তরকারির নূন চেখে দ্যাখে অপুর মা জমিলা।মনের অজান্তে এক জীবনে না পাওয়া সুখগুলোর ক্ষোভ ঝাড়তে থাকে আনমনে।
জমিলা বলতে থাকে,'গত বছর ঝড়ে ঘর ভাইঙা গেল,রোদে পুইরা বৃষ্টিতে ভিজা সারাদিন বান্দির মতো খাটি এহোন পর্যন্ত একটা চাল দেয়ার টাকা নাই।বৃষ্টি হইলে ঘর দিয়ে পড়ে পানি,ছোট ছাওয়ালডারে নিয়া কত কষ্টে থাকি হে জানবে ক্যামনে? রাত অইলে তো ঘরে আইসা মরার মতো ঘুমায়।
'ছাওয়াল ডা আবার নতুন বায়না ধরছে,ইস্কুল ড্রেস না কি,হেইডা নাকি বানায়া দেয়া লাগবো।
ভাত আনার টাকা জোগার অয়না আবার স্কুল ড্রেস!
মাস্টারগো খায়া কাম নাই, একটা জামা পইরা গেলেই তো অয়, আবার আলাদা জামার দরকার।'
কথাগুলো শেষ করার পর অস্ফুট একটা স্বর বেরোয় জমিলার কন্ঠ থেকে।তারপর বিড়বিড় করতে করতে চেলাকাঠের খড়িগুলো মাটির উনুনে গুজে দেয় জমিলা।
অপু পড়তে থাকে মনোযোগ দিয়ে।
হাতের একটা আঙুল দিয়ে মোমবাতির শিখার ভেতর বারবার হাত নাড়ায় সে।
একটা সাইকেলের শখ তার অনেক দিনের।সেই সাইকেলের ভাবনায় অপু হারিয়ে যায় কল্পনায়।
জৈষ্ঠ মাসের তালপাকানো রোদ।গাছের একটা পাতাও নড়েনা।অপুর বাবা নুরু মিয়া কাঁধে করে একটা পুরাতন সাইকেল নিয়ে আসে বাড়িতে। গলা ছেড়ে ডাক দেয় অপু কে। ঘর থেকে অপু বের হয়ে দেখে বাবা সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সাইকেল সাইকেল বলে চিৎকার দিয়ে দৌড় দিতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় অপুর।অস্থিরতায় ঘেমে গেছে সে।
অপুর মা আধঘুম অবস্থায় বলে উঠে,'এহনো ঘুমাও নাই বাবা?'
-মা,আব্বা কবে সাইকেল কিনা দিব?
-আহারে,সাইকেল সাইকেল কইরা তো শরীলডা শেষ কইরা ফালাইবা।এহুন ঘুমাও বাবা,পড়াশুনা করলে আরো কতো ভাল কিছু পাইবা।
অপু এসবের কিছুই বুঝেনা।বুঝতে চায় না।
একটা সাইকেল তার চাই।এরকম নানা স্বপ্নে অপু ঘুমিয়ে পড়ে প্রতিরাতে।
সাইকেল না পাওয়ার হতাশায় প্রতিদিন অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্কুলে যেতে হয় অপুর।মিত্থ্যা কথার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে অপুর মা তবু তাকে স্কুলে পাঠায়।
'এইতো বাবা মহাজন টাকাটা দিলেই তোমার বাজান সাইকেল কিনা দিবো।আর কিছুদিন কষ্ট করো।'
এইসব কথা শুনে অপুর মন ভালো হয়।কিন্ত সেই কিছুদিন টা কবে আসবে অপুর কাছে তার সবকিছু অজানা থেকে যায়।
তবু পরিপূর্ণ আশা নিয়ে অপু প্রতিদিন স্কুলে যায়।
একদিন সত্যি সত্যি তার বাবা সাইকেল কিনে দিবে।তার বাবা কোন দিন তাকে মিত্থ্যা বলেনি।
প্রতিদিন বন্ধুদের অনেক কথা শুনতে হয় অপুকে।অপু কিছু বলেনা ওদের।বলতে পারেনা।
তার দীর্ঘবিশ্বাস যে একদিন তার ঠিকই সাইকেল হবে।
মহাজন বাড়ির আঙিনায় বসে আছে নুরু মিয়া।
সঙ্কোচবোধ করে একটা কথা বলতে চায় সে।
কথাগুলো দলা পাকিয়ে থাকে তার গলার ভেতর, বের হতে চায় না।মিত্থ্যা একটা কাশি দিয়ে নুরু মিয়া বলে,'কাকা একটা কথা কইবার চাইলাম।'
মহাজন অন্য দিকে তাকিয়ে বলে,'কি বলবি বল।'
-কাকা, আমাকে দুই হাজার টাকা দ্যান,খুব দরকার।'
-'এত টাকা দিয়া তুই করবিডা কি? ঘরে চাইল নাই? চাইল আনতে তো এত টাকা লাগেনা।
আর মাঝে মাঝে না খাইয়া থাকাও ভাল,আল্লাহ মালিকের কথা স্বরণ হয় বেশি!'
-তা না কাকা, ছোট ছাওয়ালডারে একটা সাইকেল কিনা দিমু।ভয়ে ভয়ে বলতে থাকে নুরু।
মাথায় বজ্রপাত পড়ার মতো ভঙ্গিমা করে মহাজন চিৎকার দিয়ে বলে,
-হায় আল্লাহ! হারামজাদা কয় কি! ফকিন্নির বাচ্চা ভাত পায়না স্বপ্ন দ্যাখত্যাছে কতোবড়।
-কাকা,ছোট মানুষ একখান শখ করছে।
-এতো টাকা তোরে ক্যাম্নে দিমু? আমারে কি কোন কালে টাকা পয়সা হাওলাদ দিছিলি?
-কাকা, গতবছর দুইহান গয়না রাইখা আপনার কাছে কিছু টাকা নিছিলাম।সেই টাকাগুলাতো শোধ কইরা দিছি।এহুন যদি গয়নাটা দ্যান তো বেইচা কিছু টাকা পামু।
মুখ বাকা করে মহাজন দুইহাজার টাকা ছুড়ে দেয় নুরুর দিকে। টাকা নিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে মহাজনের আঙিনা ছাড়ে নুরু।
বাজার থেকে দুইহাজার টাকায় পুরাতন রঙ করা একটা সাইকেল কিনে নেয় নুরু মিয়া।বারবার সাইকেলের বেল চাপে, হাত দিয়ে টায়ারে চাপ দেয়।অপুর খুশির চেহারাটা তার মুখের সামনে ভাসতে থাকে।ছেলের শখ পূরণ করতে পারায় নুরু মিয়াও অনেক খুশি হয়।
আলহামদুলিল্লাহ বলে ওপর ওয়ালার কাছে শুকরিয়া জানায়।
সাইকেলটা নিয়ে নুরু মিয়া স্কুলের রাস্তার পাশে দাঁড়ায়।এখান থেকে স্কুলের ভবনের নাম দেখা যায়,সয়দাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুল ছুটি শেষে অপু যখন দেখবে তার বাবা সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে,অপু কি খুশিটাই না হবে! এই কথা ভাবতেই নুরু মিয়ার মন ভাল হয়ে যায়।
ঘড়িতে চারটা বাজতেই স্কুলের দপ্তরি যখন ঘন্টা দিলো,সব ছেলেমেয়েরা হইহুল্লোড় করে ক্লাস রুম থেকে বেড়োয়।
অপু দেখতে পায় তার বাবা রাস্তার ওপাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে।অপুর এতদিনের স্বপ্ন সত্যি হতে দেখে তার কিশোর মনটা আনন্দে নাচতে থাকে।
চিৎকার করে অপু তার বাবার কাছে ছুটে আসতেই একটা ট্রাক পাশ কাটিয়ে চলে যায় তার ওপর দিয়ে।মুহূর্তেই সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে যায় তার কাছে।তার শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পিচঢালা রাস্তায়।
নুরুর মাথায় হঠাৎ সারা পৃথিবীটা যেন ঘুরতে থাকে লাটিমের মতো।করুণ এক আর্তচিৎকারে সে ডেকে যায় আল্লাগো!
ক্ষণিকের জন্য নুরু নির্বাক হয়ে যায়।একশবছরের অবাক হওয়া চোখ দুটো শুধু তাকিয়ে থাকে রাস্তায় ছোটাছুটি করা মানুষের দিকে।
0 Comments