শওকত হোসাইন
নবনী
আমার একটা ডাকনামের
প্রয়োজন ছিলো। এটা
বুঝলাম খুব
দেরীতে।
নবনীতা আজকাল
ডাকনামে
ডাকতে চায়। বড় নামটা
নাকি সুন্দর
না।
মা হয়তো
ডাকনাম দিয়েছিলেন। বাবু
খোকা কিংবা
মানিক।
আমার মনে নেই। তখন
বেশ ছোট
ছিলাম।
মা বেঁচে
থাকলে জিজ্ঞেস
করা যেত।
নবনীতাকে বলে দেই-
মা হয়তো
বাবু কিংবা
খোকা ডাকতো। তুমিও
চাইলে ডাকতে
পারো।
নবনীতা হেসে উঠে। হাসলে
তাকে সুন্দর
দেখায়।
বলে; এখনও
কি ছোট
নাকি তুমি?
এসব ছোটদের
নাম।
তোমায় আমি
রুদ্র বলে
ডাকবো।
আমার মন খারাপ
হয়, আমি
ভেবেছিলাম নবনীতা আমায় আকাশ ডাকবে।
সারা বাজার ঘুরে
আলতা পেলাম
না।
হেনা আপার
আলতা মাখার
শখ হয়েছে। আজকাল
তার অদ্ভুত
শখ হয়। মধ্যরাতে
গোসল করে
মায়ের বিয়ের
শাড়ীটা পড়ে
ছাদে একা
বসে থাকে। চুলগুলো
বাতাসে উড়ে। দূরে
থাকা ডালিম
গাছটার দিকে
তাকিয়ে থাকে। ওখানে
মায়ের কবর। মা
মারা গিয়েছিলো
এক বর্ষায়।
প্রচন্ড বৃষ্টিতে।
মা মারা
যেতেই বৃষ্টি
নেই।
আকাশ পরিষ্কার।
আমি তখন ছয়
ক্লাস পার
করি।
হেনা আপা
নয়।
স্কুল শেষে
বাড়ী ফিরে
দেখি বাবা
কাঁদছে।
মায়ের
হাত তখন বাবার
হাতে।
আমার খুব
খুশী লাগে। অনেকদিন
বাবার হাত
মায়ের হাতে
দেখিনি।
এতো
পরম নির্ভরতার হাত
মা এতোদিন
কেন ছোঁয়নি। মায়ের
উপর রাগ
আসে।
রাগ করার
আগেই পাশের
বাড়ীর এক কাকী
বলে উঠে,
'আহা কি
ভালো মহিলা
ছিলেন হেনার
মা' শুনেই
বুকটা ধক
করে উঠে।
মা তাহলে সত্যই
ভালো মানুষ
ছিলেন।
হেনা কেঁদে
উঠে শিশুদের
মতো।
বাবা হেনাকে
জড়িয়ে ধরে
বুকে।
হেনা তবুও
কাঁদে।
আমার খুব
হিংসে হয়। কেউ
আমায় বুকে
জড়িয়ে নিচ্ছে
না।
হিংসায় আমার
খুব কান্না
আসে।
আমি একা
একা কাঁদি। বারবার
এদিক ওদিক
তাকাই।
আমায় কেউ
বুকে তুলে নেয় কি'না।
আমি ততদিনে বখে
গেছি।
মা ছাড়া
ছেলেরা অল্পতে
বখে যায়। 'ঘোমটা'য় গিয়ে
সিনেমা দেখি।
সিনেমায় নায়ক খুব
সাহসী।
রাস্তায় নায়িকার
হাত ধরে। চুমু
খায়।
প্রথম যৌবনে
এমন সিনেমা
দেখে আমি
প্রেম শিখতে
পারিনি।
আমায় প্রেম
শিখায় নবনীতা। আমি
নবনী নামে
ডাকি।
নবনী আমার
হাত ধরে। হাত
এতো গরম
কেন!
নবনীর হাত আমার
কপাল ছোঁয়। আমার
গা কাঁপতে
থাকে।
কাঁপা কাঁপা
গলায় নবনীকে
বলি 'ভালোবাসি'। নবনী
আমার মতো
কাঁপা কাঁপা
কণ্ঠে উত্তর
দেয়না।
হাত আরও
শক্ত করে
ধরে।
কানে মুখ
রেখে বলে
- চুমু খেতে
পারবে?
সে রাতে জ্বর
আসে প্রচন্ড। পাশের
বাসার হাসান
কাকা বলে
-ছেলে কি
যা-তা
খায়।
অসুখ-বিসুখতো হবেই। বাবা
কোনো কথা
বলে না। চুপচাপ
বসে থাকে। বাবাও
হেনা আপার
মতো ডালিম
গাছটার দিকে
তাকিয়ে থাকে। হেনা
আপা আমার
পাশে বসে
বসে মাথায়
জল ঢালে। হেনা
আপার চোখ
দুটো ভেতরে
চলে গিয়েছে।
বাবা হেনা আপার
বিয়ের জন্য
অনেক চেষ্টা
করে।
বিয়ে হয়না। এ
নিয়ে হেনা
আপার কোনো
দুঃখ
নেই। হাসান
কাকার বৌ-এর দুঃখ
হয় খুব।
মা মরা মেয়ে
মানেই অপয়া। তার
জন্য সংসারে
দুঃখ কষ্ট
লেগেই থাকে। এসব
শুনে হেনা
আপাকে কখনো
দুঃখ পেতে
দেখিনি।
হেনা আপা
ঘুম ঘুম
চোখে
বলে -কীরে, জ্বর কিছুটা কমলো?
আমি প্রচন্ড জ্বর
নিয়ে বলি,
রাখতো আপা। ঘুমা
গিয়ে।
এমনিতেই সেরে
যাবে।
হেনা আপা
হঠাৎ বলে,
তুইও কি
আমায় অপয়া
ভাবিস?
অন্ধকারে হেনা আপার
চোখ দেখা
যায় না। তবে
চোখ না
দেখেই বুঝা
যায় হেনা
আপার চোখ
দিয়ে
পানি পড়ছে।
হেনা আপার
জন্য খুব
মায়া হয়। কাল
ভোরেই রুপগঞ্জ
বাজার থেকে
এক কৌটো
আলতা কিনে
দিবো।
হেনা আপা
খুব খুশী
হবে।
কতোদিন হেনা
আপার খুশিমুখ
দেখিনা।
নিজেকে
নিজে প্রশ্ন করি। কতোদিন?
মা যখন প্রথম
এ বাড়ীতে
আসেন তখন
বাবা যুবক। ঘরে
খাবারও ছিলোনা। মা
বিরাট বড়লোকের
মেয়ে। বাবা
একটা স্কুলের
শিক্ষক। বাবার
সরল মুখ
দেখে মা
সব ছেড়ে
চলে আসে। সবকিছু
নীরবে মেনে
নেয়।
মাকে কখনও
কোনোকিছু নিয়ে
মুখ তুলতে
দেখিনি।
কোনোদিন হাসতেও
দেখিনি।
নতুন একটা
জীবন শুরু
হয় মায়ের। যে
জীবনে মা
অভ্যস্থ ছিলোনা
মোটেও।
মা শুধুএকটাই কথা বলতেন
বাবাকে, আমায়
একটু ভালোবাসবেন,
তাতেই হবে। যাতে
কোনোদিন মনে
না হয়
এখানে এসে
কোনো ভুল
করেছি আমি।বাবা
কোনো চেষ্টারই
কম রাখেনি। মা
হয়তো ওপারে
সুখেই আছেন।
নবনীর চোখগুলো বড়
হয়ে যায়। বড়
বড় চোখে
নবনী তাকিয়ে
থাকে।
ওটা কি?
সমুদ্দুর।
নবনী বিস্ময়ে হা
হয়ে যায়। - আমায়
সমুদ্দুর দেখাতে
নিয়ে যাবে?
নবনীর চোখে সমুদ্দুর
দেখা যায়। গাঢ়
কালো পানি
টলটল করে। স্রোত
নেই নবনীর
সমুদ্দুরে।
নবনীর চোখে তাকিয়ে
থাকতে ইচ্ছে
করছে।
নবনী লজ্জা
পায়।
লজ্জায় চোখ
নামিয়ে ফেলে। নবনীকে সমুদ্দুর
দেখানোর কথা
দেয়া হয়না
আর।
সারা বাড়ীতে আলো। লাল
নীল আলোয়
মিটমিট
করছে বাড়ী। মা
থাকতে মাঝেমধ্যে
আয়োজন হতে
ঘরে। বাবা
কবিতা পড়তো
মোমের আলোয়। মা
মুখ চুপচাপ
বসে কবিতা
শুনতেন।
ভেতরে ভেতরে
হাসতেন।
আজ হেনা আপার
বিয়ে।
মা নেই,
অপয়া মেয়েকে
কেউ সাজিয়ে
দিতে আসেনি। একা
একা সাজছে
হেনা আপা। হাট
থেকে কিনে
আনা আলতা
পায়ে ঢেলে
দিয়েছে।
ডালিম গাছের
গোড়ায় একটা
বড় মোম
জ্বলছে।
মোমের আলোর
কারণে জায়গাটা
সুন্দর দেখাচ্ছে। মা
দেখছেন হয়তো। বাবা
আজও একা
একা বসে
আছেন।
হঠাৎ উঠে
দাড়ালেন।
ডালিম গাছের
নিচে বসে
হু হু
করে কেঁদে বিয়ের
আনুষ্ঠানিকতা শেষ। বাবা চুপচাপ
শুয়ে আছেন
তার ঘরে। বিষণœভাব।
হেনা আপা
যাওয়ার সময়
একটুও কাঁদেননি।
খুব হেসেছেন। মা
মারা যাওয়ার
পর আজ
হাসলো হেনা
আপা।
বাবাকে শুধু
বলে
গেছেন, ইচ্ছে হলে দেখতে যেও,
বেঁচে আছি
কি মরে
গেছি'। আমি জানি বাবার
ইচ্ছে হবে
না।
হেনা
আপা আমায় কিছুই বলেননি।
একদিন ভোর
সকালে তাকে
আলতা কিনে
দিয়ে চমকে
দিবো।
তখনও
কি হেনা আপা
চমকাবে??
খুব ভোরে বাবা
ডাক দেন,
চল খোকা। এবার
যাওয়া যাক।
আমি উঠে বসি। এতো
সকালে কোথায়
যাবো।
ঘুম ঘুম
চোখে বাবাকে
দেখি।
বাবার গায়ে
বড় শাল।
একরাতে বাবাকে বেশ
বৃদ্ধ মনেহচ্ছে।
-কোথায় যাবো বাবা?
ভাবিনি এখনও। যেতে
যেতে ভাবা
যাবে।
তাড়াতাড়ি চল। কেউ
দেখে ফেলার
আগেই।
কাঁচা রাস্তা পাড়
হয়ে বড়
সড়কটায় উঠে
গেছি।
চেনাশোনা লোক
দেখবার ভয়
নেই।
আমি আর বাবা
চোরের মতো
পালাচ্ছি।
হেনা আপার
জন্য মায়া
হচ্ছে খুব। আপা
হয়তো কয়েক
বৎসর পর
এসে
জানবে এখানে কেউ
নেই।
মায়ের কথা
মনে পড়ছে
খুব।
তাকে ডালিম
গাছের তলায়
একা রেখে
এসেছি। আমার মা একাই থেকে
গেলো আজীবন। মনে
মনে দোয়া
করি মায়ের
কবরে একটা
তুলসী
গাছ হোক।
কেন এমনটা
হবে জানি
না।
তবুও হোক।
বাবা হঠাৎ বলে
উঠলেন- নবনীতাকে
সাথে নিবি?
নবনীর মুখটা চোখের
সামনে ভেসে
উঠলো।
তার চোখের
সমুদ্দুরটা দেখা হবেনা আর?
তার নরম হাতটা?
নবনী পাগল মেয়ে। দূরে
গেলে হয়তো
ভুলতে পারবে
না।
ঠিকানা জানলে
চিঠি লিখতো
হয়তো আমায়।
নবনীকে খুব ভালোবাসতে
ইচ্ছে করছে।
শোন খোকা।
মায়া বড়
অদ্ভুত বুঝলি। মায়া
থেকে পালিয়ে
বাঁচবি।
বাসটা ততক্ষণে শহর
পেড়িয়ে গেছে। আমি
পেরিয়ে গেছি
মাকে, হেনা
আপাকে আর
নবনীকে।
মায়া
পেরিয়ে যেতে পারিনি। ভেবে
রেখেছি কোনো
একদিন আসবো। মায়ের
কবরের চারপাশে
একটা দেয়াল
টানাবো। হেনা
আপার সাথে
অনেক না
বলা কথার
ঋন শোধ
দিবো।
আর নবনী!!
ওকে বলতে ইচ্ছে
করছে 'মেয়ে,
ভালোবেসে তুমি
আকাশ হয়ে
যাও।'



0 Comments