বিলাল হোসেন এর তিনটি অণুগল্প || শব্দমিছিল || নোঙর সংখ্যা

১.

একটু  আগে

—ওস্তাদ !

সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে গাড়ি। গাড়ির ভেতরে হালকা আলো। যাত্রী কম , মাত্র পাঁচজন। ছাড়া ছাড়া সীটে বসে আছে। যাত্রীসেবা নেই। সবাই ঘুমোচ্ছে।

গল্প করছিল তারা। আবার ডাকল—ওস্তাদ!

—কি , হইছে কি ? হাবীব ড্রাইভার ঝাঁকিয়ে ওঠে। আবার সামলে নেয়। অন্য কেউ হলে হয়ত ‘চুদিরভাই’ বলে একটা গালিও দিয়ে বসত। কথা বলছে সুপারভাইজার সফর ভাই। শিক্ষিত লোক। বয়সে বড় হয়েও ছোট হাবীবকে সম্মান করে।

—কী হইছে সুপারভাইজার ,কইয়া ফালাও। খালি রাস্তা দেখতেই পাইতেছ। ১১০ চলতেছে। এর মধ্যে আলাপ মারার টাইম কই। পেছনে ট্রাক।

—শামীম আফনারে কিছু কইবার চায় । হঠাত শামীমের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে সফর—অই মিয়া কও না ক্যা ?

রাস্তা থুয়ে এক ঝলক শামীমের দিকে তাকায় হাবীব । হাবীবের পাশে আকরাম ,জাহাঙ্গীরও। ঘটনা কিছু আছে— হাবীব বুঝতে পারে। হারামিগুলারে বিশ্বাস নাই।

সে গাড়ি স্লো করে। জাহাঙ্গীর এক খিলি পান কই থেকে জোগাড় করেছে কে জানে— লও ওস্তাদ পান খাও।ভিত্রে হাকিমপুরী আছে।

আকরাম পানির বোতলটাও এগিয়ে দেয়। সে জানে , ওস্তাদ চা আর পান খাওয়ার আগে পানি খান।

এত আপ্যায়ন! সবাই একজোট হয়ে কী কইবার চায়—কে জানে। তবে গুরুতর কিছু!

—নকরামি বাদ দিয়া কি কবি ক!—হাবীব ফুঁসে ওঠে।

—ওস্তাদ খিদা লাগছে!খামু

হাবীব অবাক হয়। বগুড়া থেকে ভরপেট খেয়ে উঠেছে। বলা যায় এখনো খাওয়া হজম শুরুই হয় নাই।এর মধ্যে খিদা পাইয়া গেল ?

—অই নাটকির পুলা , ফুড পেলেস থেইকা কি বালডা খাইলি যে এহনি খিদা লাগল ?

বকা খেয়েও হে হে করে হাসে সবাই। শামীম কান চুলকায়। আকরাম ঘাড় চুলকায়। জাহাঙ্গীর বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে কী চুলকায় কে জানে। সফর সুপারভাইজার বয়সে সবার বড়। সবাইরে মৃদু ধমকায়—ধুর মিয়ারা , আসল কথা কইবার পারো না ত আমারে ডিস্টার্ব করো ক্যান। এসবের মধ্যে আমি নাই।

হাবীব হাইওয়ের একপাশে গাড়িটা দাঁড় করায়। দু’জন যাত্রী নেমে গেল। মিরর দিয়ে দেখতে পেল গাড়িতে যাত্রী নেই বললেই চলে।পাচ সাতজন হবে।

গাড়ি ছুটে চলল উল্কা গতিতে।

—ওস্তাদ , এই খিদা অই খিদা না। মাথায় বেরা উঠছে , মাল উঠছে।

স্টিয়ারিং ধরে রাখে শক্তভাবে হাবীব। মেজাজ খিচরে গেল। বাসের মধ্যে আলো- অন্ধকার। কানের পাশ দিয়ে বাতাসের শব্দ।

—খানকির পুলারা কয় কি ! বাসের মধ্যে এত যাত্রী—মাথামুথা খারাফ হইয়া গেছে গা।

—ওস্তাদ রাগ কইরো না। আমাগো হিসাব আছে। সামনে যমুনা সেতু। তার আগেই পাচজন নাইমা যাইব সিরাজগঞ্জের মোড়ে। বাসে থাকব খালি একজন। পুরা বাস ফকফকা। ওস্তাদ না কইরো না ।

—পুলিশ কেস হইলে কে সামলাইব , তর বাপে ?

—কী যে কও না ওস্তাদ! আইজ পর্যন্ত হইছে ?

হাবীব সফরের দিকে তাকায় এক মুহুর্ত—তুমি কি কও সুপারভাইজার ?

—চ্যাংড়া পুলাপাইনরা একটা আবদার করছে ওস্তাদের কাছে। ‘হ’ কইয়া দেও।

হাবীব কিছুক্ষণ থেমে বলল—আমি নাই এসবের মধ্যে। সাবধানে করিস। চিল্লাচিল্লি য্যান না শুনি। নডির পোলাগো এত খিদা কইত্থন যে পায়!

—তুমি খাইবা না ওস্তাদ! তুমারে দিয়া বনি করি।

—দেহস না আমার হাত বান্ধা! তোরা শুরু কর—ফি আমানিল্লাহ!

বাস যমুনায় উঠেছে , একজন যাত্রী নিয়ে। বাসের হেল্পার শামীম এগিয়ে গেল যাত্রীর দিকে।

------------------------------


এ কী লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ, প্রাণেশ হে,


আনন্দ বসন্ত সমাগমে ...


জানালাটা এক্টু ফাঁক রেখে চোখ বুজে হেডফোনে গান শুনছিল রূপা । রূপার মত কেউ।

 

চিৎসাঁতারের কাব্য

পুকুর লাগোয়া কদমগাছ। ঝুঁকে আছে।মুখের কাছে আকাশ নেমে আসে। শুকনা পাতা ঝরে পড়ে। বাতাসও কেমন একটা ভাব নিয়ে চলে যেতে যেতে একবার দেখে নেয় আমাকে।

একটা হাঁস আর কয়েকটা হাঁসেরবাচ্চা দয়া করে একবার দেখে যায়। একটা খেকশেয়াল মুরগী ধরার ধান্ধা নিয়ে কচুবনের আড়ালে বসেছিল। দেখছিল আমাকেও।

আমি চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে সব দেখি।

জলফড়িঙের পাখার শব্দে ঢেউ ওঠে। জলের বাষ্প ছিন্ন হয়ে যায়। তছনছানো জলকণা আমার চোখের পাতায় পড়ে ঝুর ঝুর করে।


একটা দু’টা ফিঙে কি মাছরাঙা কি অজানা পাখি ডেকে ওঠে পুকুর ঘিরে। তাদের গলায় ব্যথা। বিষণ্ণতা আমারকে বিহ্বল করে।

আমি ভাসি , ভাসতে থাকি।

চিৎসাঁতারে আমার কান্না পায়। আমি বুঝি না আমাকে। আমার চোখ আমার ত্বক আমার নাসিকা আমি চিনতে পারি না। সবকিছু অপরিচিত লাগে। আমার ঘোর আমার তন্দ্রা আমার মতিছন্নতাকে আমি চিনিতে পারি না।আমি চিৎসাঁতার দিতে দিতে ডুবে যাই ,ভেসে উঠি।

আমি ভুলে যাই। আমি পুকুরে ভাসছি , ডুবছি , সাঁতার কাটছি। আমি ভুলে যাই , আমি কত কিছু যে ভুলে যাই ।

আমার গলা ব্যথা করে। কান্না পায়। আমাকে কেউ মেরে ফেলে দিয়েছে পুকুরে—মনে পড়ে।

সামান্য ঢেউয়ে খসে যায় আমার গায়ের মাংস চামড়া। সাদা মাংস খুঁটে খেতে আসে মাছেরা। ঝাঁকে ঝাঁকে।

—হুস হুস হুস।

তারা কথা শোনে না। তারা টেনে নিয়ে যায় পুকুরের এককোণে। কুচুরিপানার বনে।

কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল দেখে কিছু মনে পড়ে আমার। মার নীলশাড়ি। কাকার সাদা পাঞ্জাবি। ওরাইত আমার হাত পা চেপে ধরেছিল। আমি কি কিছু দেখেছিলাম ইস্কুল থেকে আসার পর ?

প্রথমে ওরা আমাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে। তারপর ছুরি দিয়ে আমার পেট ফেরে নাড়িভুঁড়ি বের করে কদম গাছের গোঁড়ায় পুঁতেছে। আমার খালি পেটে ইটের আধলা ঢুকিয়ে সেলাই করে পুকুরে ডুবিয়ে দিয়েছে। অনেকদিন ডুবেছিলাম। শরীর পচে সেলাই খুলে গেলে ভুস করে জলের ওপরে ভেসে উঠেছি।

খনকার বাড়ির এই পুকুরে কেউ আসে না। ঘুঘু চড়ানো ভিটা। পাশের রাস্তা দিয়ে তোমরা যাও—আমি টের পাই। গাড়ির চাকার শব্দ , সাইকেলের টুংটাং শব্দ পাই। কিন্তু এ পড়োবাড়ির পুকুরের দিকে কেউ আসে না।

বাবা , বাবা তুমি কোথায়? একবার আসো। আরকতকাল বিদেশে থাকবে তুমি !

তোমরা যারা এই লেখা পড়বে , একবার এসো। দেখবে আমি কেমন শুয়ে শুয়ে গলে যাচ্ছি ।

শেয়ালটা ধীরে ধীরে কাছে আসছে। আসুক। আমি চোখ বুঁজে থাকি। আমার চোখের ওপর ঝরে পড়ে কদমগাছের পাতা।

দারোয়ানি

লোকটা বলল—আমি দারোয়ান।

কিন্তু লোকেরা তাকে কোথাও দারোয়ানি করতে দেখেনি। না দোকানপাট বা কারো বাড়িতে। লোকটি একটা চৌরাস্তার মোড়ের এক কোনায় দিনরাত দাঁড়িয়ে থাকে।

অদ্ভুত না?

আমারা যারা নুতুন নতুন ,তারা লোকটাকে দেখি;কাছে গিয়ে দাঁড়াই। টুকটাক কথা বলি।

—আপনি কে বলুন ত ?

লোকটার মুখে সাদাকালো দাঁড়ি। এই দাঁড়িতে চুলকাতে শুরু করল। তার চোখ আমাদের ছেড়ে কোথায় কোথায় ঘুরে এল ।

— আপনি কি চান , সারাদিন এই রোদের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকেন। গরম লাগে না?

লোকটার পরনের পাঞ্জাবী ময়লা। ছেঁড়া। পাঞ্জাবীর ওপর ছড়িয়ে দেয়া চাদর। তাও ময়লা –ছেড়া আর অতিজীর্ণ। পাঞ্জাবী হাতরে একটা ললিপপ বের করে সামনে মেলে ধরল—নেও খাও। খাইতে খাইতে বাড়ি যাও।

আমরা আমাদের দিকে একবার করে তাকাই। আমি তাকাই মায়েনের দিকে। মায়েন তাকায় সায়েনের দিকে। সায়েন কার দিকে তাকাবে খুঁজে না পেয়ে আমার দিকেই তাকায়। আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখদুটি হাসছে।

নেব না , নেব না করেও আমরা ললিপপ নেই। আরেকটা ললিপপ আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল— তোমার আব্বুরে দিও। সে ললিপপ খুব পছন্দ করত।

আব্বার জন্যে ললিপপ!

—তোমাদের বাবারা যখন ছোট ছিল , আমার কাছে ললিপপ নিতে আসত।

কথা শুনে আমাদের মাথা ঘুরে গেল। ঘরে গিয়ে বাবাকে বলতেই বাবা ভয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন—আর কখনও তার কাছে যাবে না। কখনও না। তোমাদের ছেলেমেয়ে যখন হবে তাদেরও নিষেধ করে দেবে।

—লোকটা কে ?

—জানি না। আমরা কেউ জানি না। লোকটাকে সবাই দেখতে পায় বিভিন্ন জায়গায়। আর কীসব অদ্ভুত কথা বলে।

—উনি নাকি দারোয়ান ?—

জানি না। সবাই বলে উনি চৌরাস্তার দারোয়ান। আকাশের দারোয়ান। পৃথিবীর দারোয়ান। আর কখনও তার কাছে যাবে না। ললিপপ নেবে না।

এই ঘটনাটা আমার দাদুর জীবনে ঘটেছিল। দাদুর বাবারাও নাকি লোকটিকে দেখত। কথাগুলি দাদু বলেছিল আমার বাবাকে। বাবা আমাকে বলার সুযোগ পায়নি। আমার বয়স হওয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন। ফলে আমি লোকটাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করে বললাম—আপনি আকাশের দারোয়ান হলে আকাশে চলে যান না কেন ? লোকটি এই প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না—চমকে গেল।

—ভাবছি চলেই যাব। ঘুষ দুর্নীতি হত্যা অশিক্ষা ধর্মান্ধতা বেড়েই যাচ্ছে। লোকেরা কথা শুনছে কই? দায়িত্ব পালন করতে করতে আমি ক্লান্ত।তুমি যাবে আমার সাথে ?

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

এক গভীর নিশুতিরাতে লোকটা আমাকে নিয়ে পৃথিবী থেকে লাফিয়ে পড়ল। গহীন নিকষ অন্ধকার শূন্যতাটুকু ছাড়িয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আলোর উজানে। আমরা দেখলাম শুধু আমরা নই , আলোর উজানে ভাসছে আরও কিছু মানুষ। লাল শাদা কালো মানুষের দল। আর প্রত্যেক দলে একেকজন করে দারোয়ান। সব দারোয়ানের চেহারা একরকম। আমরা দেখলাম পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে জলে। একটি জলভরা ললিপপের মত দেখাচ্ছে। চাটবে বলে হাতে কাঠি নিয়ে বসে আছেন মহাপ্রভু। বিরাট শিশু।

Post a Comment

0 Comments