শামসুর রাহমান : বাংলা সাহিত্যের অপরিহার্য অধ্যায়
মৃধা আলাউদ্দিন
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ইউরোপের সাহিত্যে ছিল এক জোড়া নাম- টেড হিউজ ও টম গান। আমাদের ছিল শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। আজ আমরা শামসুর রাহমানকে নিয়ে কিছু বলার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা করব। শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি ছিলেন আমাদের নাগরিক কবি। শামসুর রাহমান পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মর্নিং নিউজে সহসম্পাদক হিসেবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান-এর সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন এবং ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি একইসঙ্গে দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক হন। ১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাকে পত্রিকা থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলায়। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে।
কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের কাব্যপ্রতিভা ছিল আকাশের মতোই বিশাল, দিগন্ত বিস্তৃত। কাব্য-ইতিহাসের নানা ধারা ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে কবির ছিল নিবিড় সখ্যতা। সাহিত্যের রূপ-রস-গন্ধ- ছন্দ-অলঙ্কারকে একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। কেউ কেউ তাকে গণতন্ত্রের কবি, স্বাধীনতার কবি, মুক্তিযুদ্ধের কবি, ঢাকাইয়া কবি ইত্যাদি সরল অভিধায় অভিহিত করেন। যে যাই করুক না কেনো, কবি শামসুর রাহমান আমাদের বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ, অপরিহার্য অধ্যায়। অনেকেই তার কবিতার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং শহুরে সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে নিবিড়ভাবে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন আলোর ষড়ৈশ^র্য, সুন্দর পিরামিডের মতো। তবে এ কথাও সত্য- বাংলা সাহিত্য-সমালোচনাধারায় গভীর পাঠ খুবই কম এবং এ ধ্যানমগ্ন পাঠের সমস্যা বহমান নদীর মতোই বয়ে যাচ্ছে আমাদের সাহিত্যধারায়।
২.
পঞ্চাশের দশকে শামসুর রাহমানরা বাংলা কবিতায় যে প্রকাশ ঘটান তা ছিল সমাজ-সৌন্দর্যের নিবিড় বৈশিষ্ট্য। কবিতায় পূর্বকথিত পালাবদলের নান্দনিকতাকে অগ্রাহ্য না করেই তারা সমাজ ও জীবনবাস্তবতার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। আমাদের আজকের আলোচিত কবি শামসুর রাহমান তার কবিতায় শহুরে ও স্বদেশভিত্তিক সমাজচেতনা, শ্রেণিচেতনার সঙ্গে রোমান্টিকতারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন বেশ মুন্সীয়ানার সঙ্গে। যা মানুষকে খুব সহজেই পাঠমুগ্ধ করে। মানুষ তন্ময় হয়ে পড়তে থাকেন কবিকে।... পঞ্চাশের কবিদের, শামসুর রাহমানদের কাব্যাভুবনে একদিকে ছিল মানবতাবাদ, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রভাব- তাদের অনেকের কবিতায় ভূখ-প্রভাবের চেতনাও ছিল লক্ষ করার মতো। তবে সাধারণ বিবেচনায় শামসুর রাহমানদের কাব্যচর্চার পেছনে প্রেরণা হিসেবে মাতৃভূমি-মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সামাজিক প্রত্যয় যেমন ছিল, তেমনি নান্দনিক বিচারে আধুনিক কাব্য-অন্বেষা, অভিনবত্ব ও নতুনত্বের আকাক্সক্ষাও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি পঞ্চাশের কবিরা শৈল্পিক দায়বদ্ধতারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাদের কাব্যভুবনে। এদের মধ্যে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ অন্যতম।
৩.
কবি শামসুর রাহমানের কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করলে নগরকেন্দ্রিক চেতনার প্রবলতা খুব সহজেই চোখে পড়ে। শহুরে মানুষের জীবনের সুখ-শান্তি, ভালোবাসা, ক্লান্তি, নৈরাশ্যবোধ প্রকাশ করে পাঠককে তিনি নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করেছেন। তার কবিতায় শহরের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও অপূর্ব কাব্য-ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ। কবি শামসুর রাহমান তার কাব্য স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন- একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, মিতসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য), স্বাধীনতা পদক, আনন্দ পুরস্কার- ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।
শামসুর রাহমানের ‘একটি কবিতাসন্ধ্যা এবং তুমি’র একাংশ- তুমিহীনতায় মঞ্চে বসে একটিও প্রেমের কবিতা পড়তে পারিনি/কবিতাসন্ধ্যায়; আমার হস্তধৃত/বইয়ের পাতাগুলো,/বিশ্বাস করো, পোড়োবাড়ি হয়ে গেল/আমার নিজেরই কবিতা চাপা ক্ষোভ আর অভিমানে আসর ছেড়ে/চলে গেল যেনো মহররমের মিছিলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে...
0 Comments