সারা ঘর জুড়ে মহুয়াফুলের তীব্র করুণ গন্ধ
ঋতো আহমেদ
১.
২২শে মে, ২০২০। লকডাউন চলছে লাগাতার। দিনগুলোও ততোদিনে খুব একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। বই পড়ে, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কিংবা মুভি দেখে আর সময় কাটছিল না কিছুতে। একটু পর পর ফেসবুকে ঢু মারছি। তেমনি একসময় নিউজফিড স্ক্রল করে নিচে নামতে গিয়ে চোখ আটকে গেল কয়েকটা ছবিতে। অনেকেই পোস্ট করেছেন একজনের ছবি। খুব পরিচিত একজন। কিন্তু কেন-ই-বা হঠাৎ করে সবাই ওঁর ছবি দিচ্ছেন? ভেতরটা খচমচ করে উঠলো। হ্যাঁ, তিনিই তো। চলে গেলেন বুঝি? এতো তাড়াতাড়ি! কতো বয়স হয়েছিল? শঙ্খদার চেয়ে বেশি কি? তিনি তো দিব্যি আছেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে যার কবিতার সাথে পরিচয়। শঙ্খ ঘোষের সেই কবিতা..‘এতো বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/ শব্দহীন হও/ শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর..।’ একেবারে মর্মে গিয়ে বিঁধেছিল আমার। সম্ভবত সেই প্রথম অবচেতন ভাবেই কবিতার জগতের গভীরে ডুবে যাওয়া। কতো হলো শঙ্খদার? ৮৮। তার চেয়ে তো বেশি হয়নি আপনার!
বইয়ের আলমারি খুলে নামিয়ে আনলাম কবিতা সমগ্র/প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। বছর দুয়েক আগে তক্ষশিলা থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। আমার নিভৃত আবিষ্কারের ঝুলিতে যে একান্ত কিছু নাম রয়েছে, ওগুলোর মধ্যে এই নামটা অন্যতম। প্রতি শুক্রবার ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যাওয়া আমার পুরোনো অভ্যেস। আজিজের বইয়ের দোকানগুলোতে কিংবা শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে অনেকটা সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁজে বের করি। এ এক অন্য রকম আনন্দ আমার। কবি ও কবিতা আবিষ্কারের আনন্দ। মাঝেমধ্যে এমনও হয়েছে, দোকানের কর্মচারী এসে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে স্যার আজকের মতো ক্ষান্ত দিন।
প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৭, মহালয়ার পুণ্য তিথিতে। কোলকাতায়। এমনই লিখা আছে বইটির ব্যাক ফ্ল্যাপে। কিন্তু কী আশ্চর্য! তখন কবিতা পড়ে একবারও মনে হয়নি তাঁর বয়স এতো হতে পারে। কেন এমন হয়? কবিতার জন্যই তো। যে ভাষায় তিনি কবিতা লিখে গেছেন সে ভাষা কোনো ভাবেই বুড়ো নয়, প্রবীণও নয়। বরং বলা যায় একেবারে নবীন এই ভাষা। হতে পারে, কোনো ভাবে হয়তো ১৯৩৭ লিখাটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। আর গেলেই-বা কি। আমি হয়তো কবিতায় মুগ্ধ হয়ে এতোটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে অত্যন্ত আধুনিক আর স্মার্ট তাঁর কাব্যভাষা, ঝরঝরে আর পরিপাটি তাঁর শব্দ চয়ন আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করেছে। সে'দিন তক্ষশিলায় বইটি হাতে নিয়ে প্রথম যে কবিতাটি চোখে পড়ে—
নিজস্বী তোলার ঝোঁকে এ-যুগের যুবা ভোলানাথ
অ্যালেক্স গোমেজ
গলায় জড়িয়েছিল ঠকঠকি সাপের চিত্রময়
অহংকারী লেজ!
সবেমাত্র সেলফি'র শাটারে রেখেছে তার হাত,
ঠিক সে-সময়
উগরে দিল সমূহ গরল সেই বন্য বিষধর।
জীবন্ত অ্যালেক্স পরমুহূর্তে নিথর।...
সুদূর আমেরিকায় ঘটে যাওয়া একটি দূর্ঘটনা নিয়ে চমৎকার একটি কবিতা। প্রশ্ন আসতে পারে, এমন কবিতা কি অন্যরা লিখছেন না? তাহলে এই কবিতাটির এমন নজর কাড়ার কী আছে? আছে। কেননা, এইখানে এসে, সময়ের সাথে সাথে বর্ষীয়ান এই কবি ও তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু, শব্দচয়ন দারুণভাবে সমসাময়িক হয়ে উঠেছে। ক'জন কবি-ই-বা পারেন নিজেকে সময়ের সাথে বদলে সমসাময়িক করে তুলতে? এরপর ওখানে দাঁড়িয়ে আরও কিছু কবিতা পড়ে ফেলি আমি। একবারও মনে হয় না যে কবির বয়স আশির উপরে হতে পারে। আর এজন্যই হয়তো তাঁর এই মৃত্যু অকাল প্রয়াণ মনে হচ্ছে আমার কাছে। মেনে নিতে পারছি না যেন।
২.
প্রণবদার কবিতা পড়তে গিয়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কবিতায় কোনো কঠিন কিংবা চমকপ্রদ শব্দ নেই। আটপৌরে সহজ-সাধারণ শব্দগুলোই নির্বাচন করেন তিনি। ঠিক যেমন আর্জেন্টিনার কবি বোর্হেস তাঁর একটি কবিতার বইয়ের কিছু ভূমিকায় একবার বলেছেন, কবির কাজ শব্দকে তার আদিম শক্তি ফিরিয়ে দেয়া। দুটো প্রধান দায় আছে কবিতার। বিশেষ কোনো মুহূর্তে পাঠকের মধ্যে কবিতাকে সঞ্চারিত করে দেয়া আর তাকে প্রায় শারীরিক ভাবে স্পর্শযোগ্যতায় নিয়ে যাওয়া।
প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালের নভেম্বরে, সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায়। সে হিসেবে তাঁকে পঞ্চাশের কবি বলা যায়। '৫২ থেকে ২০২০। ৬৮ বছরের সুদীর্ঘ এই কবি জীবনে তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই মাত্র সাতটি। এর মানে কিন্তু এই নয় যে তিনি কম লিখেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর অসংখ্য কবিতা। সে হিসেবে তাঁর অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যাই বেশি। তাহলে বই হলো না কেন আরও? জানা যায় কবিতা বাছাইয়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই খুঁতখুঁতে। অত্যন্ত ছন্দকুশল এই কবি বিশ্বাস করতেন, ছন্দ না-জেনে ছন্দকে ভাঙা যায় না এবং কবিতায় দুরূহতা থাকতেই পারে— দুর্বোধ্যতা নয়। বলা হয়ে থাকে শুরু থেকেই তাঁর কবিতা একটু অন্য ধারার। কী সেই অন্য ধারা? অপেক্ষারও যে একটা রং থাকে, জলও যে মানুষকে দগ্ধ করে কিংবা ছায়ার পাখিরাও যে পাখা ঝাপটে ছটফটায়— তাঁর কবিতা পড়েই জানতে পারি আমরা।
পঞ্চাশের তুমুল জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কবিতা সিংহ, বিনয় মজুমদার, আলোক সরকার, উৎপল কুমার বসু, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং অবশ্যই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এঁরা ছিলেন বহু উল্লেখিত আর আলোচিত কবি। কিন্তু এঁদের পাশাপাশি আরও কয়েকজন কবি কবিতা লিখে গেছেন সমান তালে। তবে তাঁরা রয়ে গেছেন নিভৃতে। ঈষৎ উপেক্ষিত। অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত। এদের মধ্যে রয়েছেন আনন্দ বাগচি, দীপক মজুমদার, মানস রায় চৌধুরী, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, তারাপদ রায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমূখ। এঁরা কেউ কবিতায় কিংবা মানসিকতায় এক ধরনের ছিলেন না। প্রত্যেকের ছিল আলাদা কবিস্বভাব, আলাদা লিখনশৈলী। আমার মনে হয়, আজ সময় এসেছে বাংলা কবিতার পঞ্চাশের এই দিকটায় আলোকপাত করার।
আমরা যে ছিলাম, কারও মনেই পড়েনি দীর্ঘকাল।...
১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অতলান্ত’। তারপর দীর্ঘ বিরতির শেষে ১৯৭৭ এ এসে ‘এসো, হাত ধরো’। কিন্তু না। এর পরবর্তী বই আরও ১৬ বছর পর ১৯৯৩ এ ‘অপেক্ষার রঙ’ হাতে পায় পাঠক। এই দীর্ঘ বিরতির ভেতর দিয়ে কবি নিজেকে ভেঙে কীভাবে এগিয়ে এসেছেন পরবর্তী বইয়ে সেটা জানার জন্য অবশ্যই গভীর মনোযোগ নিয়ে পড়তে হয় তাঁর কবিতা। বুঝা যায় তিনি কখনো সমসাময়িকদের সাথে পাল্লা দিতে চাননি। সংসার, সমাজ আর পরিপার্শ্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়েও প্রকৃতপক্ষে আপন জগতে মগ্ন হয়েই লিখে গেছেন তিনি। হয়তো-বা এজন্য তাঁকে আমরা কোনো কাব্যিক কোলাহলে মুখরিত পাইনা। শুরুর দিকে পঞ্চাশের অন্য কবিদের মতোই তাঁর অতলান্তে আমরা শুনতে পাই এক রোমান্টিক সুর। নিসর্গপ্রীতি। টুকরো টুকরো ছবি দিয়ে গেঁথে তুলেন সম্পূর্ণ ভালোবাসা।
আমি কেবল তাকে হারাই, সে যে সুদূর
সে যে গহন, আমি তাকে খুঁজে না পাই,
আমি যে তার বেদনারই হারানো সুর,
আমি তাকে পেয়ে হারাই, পেয়ে হারাই!...
সীমা-সুদূর। অতলান্তের প্রথম কবিতা। এরপর অপ্রাপণীয়ার ঝরাপাতাদের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে.. মন-রাঙানিয়ার আবেগ-ভীরু ভালোবাসার প্রদীপ জ্বেলে-র মধ্য দিয়ে দারুণ রোমান্টিক দীপ্তির ভেতর বৃষ্টির পর থমথমে এক আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায় যেন পাঠক। এরপরই অতলান্ত.. হারিয়ে যাবার ভয়ে-ভয়ে দূরে-দূরেই থাকি/ ভীরু হৃদয়-মন! যতিচিহ্নের ব্যবহার যে কতোটা সাবলীল আর লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় না-পড়লে সেভাবে কোনদিন হয়তো বুঝা যেত না। পঁচিশটি কবিতা নিয়ে অতলান্ত যেন এক আশ্চর্য রোমান্টিক মৃত্যু। সম্পূর্ণ আলাদা স্বর। আলাদা কাব্যভাষা। দূরযান, মায়ামুখ, স্বপ্নকল্প, একটি শীতের রাত্রির মতো কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমরা এগিয়ে যাই আমাদের স্মৃতির বেদনার ছায়ার দিকে। এর ১৩ বছর পর ‘এসো, হাত ধরো’ তে এসে পাই অদ্ভুত বিষণ্ণ এক সুর। এই ১৩ বছরে কী এমন ঘটেছে যে কবি আমাদের অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইছেন—
এসো, হাত ধরো, ওই দিকে
আমি নিয়ে যাব।
অন্যদিকে যাবে?
তাও হাত ধরো।
.
.
ততদিন হাত ছাড়বো না।
তুমি যখন যেদিকে যাবে, বলব না, যাও। বলব, এসো।
মূল্যের অধিক মূল্যে তোমাকে জেনেছি, পরিত্রাণ।
একটা অন্তর্গত হাহাকার বয়ে যাচ্ছে যেন এই বইয়ের কবিতাগুলোয়। শব্দের সমূহ যুক্তি ভেঙে যায়, ভেঙে-ভেঙে যায়। কী যেন হবার ছিল, হল না কিছুই। চারদিকে আঁধার করে মেঘ জমে। ঝাপসা গাছপালাগুলো শিকড় নামিয়ে দেয় বুকের ভেতর। কী ছিল, কতটা ছিল, স্পষ্ট করে বুঝা যায় না। কৌতূহল ভেঙে গেলে যেভাবে মানুষ ফিরে যায় এই বইয়ে যেন সেভাবেই ফিরে যাচ্ছেন কবি। বিষণ্ণ মনে। তারপরও যেন ফিকে স্মৃতির ছবির টানে আমাদের বেঁচে থাকা কোথাও আশার সঞ্চার করে। খোলসের মতো পিছনে পড়ে থাকে পুরনো জামা।
নখ থেকে ছিটকে পড়ল এক চিলতে রক্ত:
তাজা টলটলে পদ্মরাগমণি।
পদ্মরাগ না রক্তবীজ?
আমার সারা শরীর ভিত-পর্যন্ত কেঁপে উঠল যেন
হঠাৎ, তখনই।
আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম
রক্তের সেই বিন্দু থেকে জন্ম নিচ্ছে এক স্পষ্ট অবয়ব।
হুবহু সেই মুখ, সেই স্বর,
তর্জনী উঁচিয়ে সটান এগিয়ে আসছে আমার দিকে:
তুমি হন্তারক।...
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে যেন। কী নিপুণ ছন্দে আবদ্ধ। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়া স্বর।
৩.
প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় মাঝেমধ্যেই ফুটে ওঠে দৈনন্দিন জীবনের ছবি, খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার ভেতর যেমন গল্প বা গল্পে গল্পে কবিতার কথা মনে পড়ে, তেমনি প্রণবদার কিছু কবিতায়ও আমরা গল্প খুঁজে পাই। আর ঘুরে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ কিংবা কলি। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় প্রায় চল্লিশ জন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীর নাম পাওয়া যায়। এও এক অদ্ভুত ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর এতো গভীরে প্রথিত ছিল যে বিভিন্ন ভাবে তা তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘কেমন আছে এই পৃথিবী' তে এই ব্যাপারটা যেন অনেক বেশি প্রতিভাত হয়েছে।
প্রশ্নটা উপলক্ষ, আসল কথা জমে ছিল তাঁর নিজেরই বুকে,
আর তাই
উত্তরের ধার না ধেরেই তিনি খুলে দিলেন
অবরুদ্ধ এক উৎসমুখ।
কিংবা
সবই এখন বুঝতে পারি।
কে কটা এঁটেছে মুখোশ,...
...নিয়ে ১৯৯৩ সালে এলো ‘অপেক্ষার রঙ’। এরপর ২০০৫ এ ‘জল, তবু দগ্ধ-করা’। দিন যায়, রাত্রি যায়— কিছু অন্যরকম ছবি দেখতে পাই আমরা। জীবন এক প্রতিচ্ছবি, তবুও যেন পাথর। হিম হিম হাওয়া এসে ছুঁয়ে যায় বুক। জেগে ওঠে পুঞ্জীভূত স্মৃতি। একদিকে ভয়, অন্যদিকে ভালোবাসা। বিচিত্র টানাপোড়েনের জীবন-সংসার মানুষের। কিন্তু এর মধ্যেও যে আমরা ফুটে উঠতে চেয়েছিলাম একান্ত একটা নকশা হয়ে। প্রথম বৃষ্টির রোমাঞ্চকর ফোটার মতন। তারপর সেই নকশাও কীভাবে যেন বদলে যায়। একদিকে উদ্বেগ, অন্যদিকে পিছুটান। বুঝে উঠতে পারি না— জীবনের গোপন বিষের তীব্র দাহ।
নেই বললে নেই,
পলক পড়তে না-পড়তে পর মুহূর্তেই।
মৃত্যু কি ম্যাজিক?
এই ছিল এই নেই, শূন্য খাঁ-খাঁ, স্তব্ধ চতুর্দিক।
জীবন্ত নাটকে
অতর্কিত চরিত্রেরা মঞ্চে উঠে সজোর পা ঠোকে।
বন্ধ করে চোখ
লাশকাটা ঘরে শুয়ে অবশেষে অন্তিম দর্শক।…
কিংবা
দৃশ্যের সবুজ থেকে অদৃশ্যের গাঢ় অন্ধকারে
যেখানে তাকাও, দ্যাখো, একই স্রোত বাহিরে-ভিতরে।…
বহু সনেট লিখেছেন তিনি। নির্মাণশিল্প নিয়েও তিনি ছিলেন বেজায় সচেতন। আবেগ উচ্ছ্বাসকে সংযমের শাসনে বাঁধতে জানতেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। তাঁর কবিতায় অকারণ বাহুল্য নেই, আছে স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ। আর ছন্দ। আর ছন্দ।
২০০৭-এ দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘শো-কেসের ফুলবাবু’ আর ‘এত মায়া, এত মোহ’। আসুন এত মায়া, এত মোহ থেকে একটি কবিতা পড়ি— কবিতাটির নাম আত্মবিবরণী।
এখন সামনের দিকে, বলতে গেলে, কিছুই দেখি না।
না মানুষ, না নিসর্গ, রাস্তাঘাট, সমাজ, প্রগতি,
না দায়বদ্ধতা কোনও। এমনকী, অতি
সাধারণ মূল্যবোধও আচমকা উধাও প্রতি স্তরে।
মাঝেমধ্যে তাই
চশমার কাচ মুছি, অন্যমনে দু'হাত বোলাই
নিজের গায়েই,
চিমটি কেটে বুঝতে চাই, বেঁচে আছি কি না।
টের পাই, আছি, তবু নেই,
এক শূন্য নীরন্ধ্র প্রহরে।
অদৃশ্য ডুবুরি নামে বুকের ভিতরে বারবার।
আঁতিপাঁতি খুঁজে দ্যাখে, দেখা যায় ততটা তলায়—
বারবারই উঠে আসে আত্মঘাতী একটি যে-কুঠার
ছিন্ন শিকড়ের শেষ চিহ্ন শাণিত ফলায়।
কী মনে হচ্ছে এই কবিতাটি পড়ে? প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। বাংলা কবিতার নিভৃতচারী অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি। তাঁর কবিতা পড়লে পদে পদে আবিষ্কারের আনন্দ পাওয়া যায়। অত্যন্ত দৃঢ় আর প্রত্যয়ী তাঁর প্রতিটি পঙক্তি।
কাঙাল করেছ যাকে, নিয়েছ সর্বস্ব কেড়ে যার—
তবু কেন সে-ই তার কাছে
এইভাবে হাত পেতে ফিরে-ফিরে আসো বারবার?
0 Comments