রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে
রাহুল বিশ্বাস
অতীতে বিজেএমসি'র অধীনে ছিল ৭৭টি পাটকল। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে যার বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয়। বর্তমানে দেশে ২৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রয়েছে যা ইতোমধ্যেই বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার।
বাংলাদেশের পাটের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। গোটা পৃথিবীর মধ্যে পাটের শ্রেষ্ঠ ভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৫০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। আবার বিশ্বের মোট কাঁচাপাট রপ্তানির ৭৮.৫৪ শতাংশ করা হয়ে থাকে বাংলাদেশ থেকে, যার বড় অংশটাই আমদানি করে ভারত। ভারত কোন প্রকার কাঁচাপাট রপ্তানি করে না। কাঁচাপাটকে নেহাত মূল্যদরে রপ্তানির চেয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা থেকে উৎপন্ন পণ্য রপ্তানি করা কতটা লাভজনক সেটা বুঝতে বিশেষ কোন পণ্ডিত হবার দরকার পড়ে না। বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট দিয়ে তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাস্তবতা হল দিন কে দিন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অথচ ভারত বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল কিনে সেটা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রোডাক্ট বিদেশে বিক্রি করছে এবং মুনাফার পাহাড় গড়ছে। আবার আমাদেরই দেশের মধ্যে থাকা প্রাইভেট মালিকানাধীন পাটকলগুলোও ভারতের মতো একইভাবে লাভের বন্যায় সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। পাট উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশ হলেও পাটের বর্তমান বিশ্ববাজার ভারতের দখলে।
সরকারী পাটকলগুলোর লোকসানের কারণগুলো সবিস্তারে জানা দরকার। সেক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বলা দরকারদেশের পাটের ভালো মানের কাঁচামালগুলো মূলত দুই দিকে চলে যাচ্ছে সেকথাটা। প্রথমত, দেশের মধ্যে ব্যক্তি (প্রাইভেট) মালিকানাধীন পাটকলগুলোতে; দ্বিতীয়ত, আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাকে বোধহয় প্রথমে বলা উচিত। কারণ আমাদের কাঁচাপাট সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারতকে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। যাইহোক দেশের ব্যাপারটা আগে খুলে বলি। আমাদের দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি মালিকানাধীন পাটকলগুলোর মালিক পলিটিক্যাল লোকজন আবার তারাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা (বিজেএমসি) এর 'হত্তাকত্তা' লোকজন অর্থাৎবিজেএমসিকর্মকর্তারপ্রায়সকলেইবেসরকারিএকএকটিপাটকলেরমালিক, বাকিরা ধনাট্য, উচ্চশ্রেণীর ব্যবসায়ী কিংবা ঋণখেলাপি লোকজন। সরকারি বা সরকারপুষ্ট এসব ব্যবসায়ীরা নিজেদের ফায়দা লোটার জন্য গোপনে পাট মন্ত্রণালয়ে প্রতি মণ পাটে ১০০ টাকা বা তার অধিক টাকা ঘুষ দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে অর্থাৎমন্ত্রণালয়থেকেবিজেএমসিওমিলব্যবস্থাপনাপর্যন্তদুর্নীতিবাজদেরঅধিপত্য।এসকল কারণে মন্ত্রণালয় থেকে ইচ্ছে করেই সরকারী অর্থ বরাদ্দের টাকা সরকারী পাটকলগুলোতে পাট মৌসুমের তিন চার মাস দেরিতে দেয়া হয়, বেসরকারি মালিকেরা ঠিকই পাট মৌসুমে কম টাকা দিয়ে (১০০০ বা ১২০০ টাকা) পাট কিনে। যখন সরকারী পাটকলগুলোকে ১০০০ বা ১২০০ টাকা মণের পাট ২৪০০ বা ২৫০০ টাকায় কিনতে হয়। আবার গুনগত মানের দিক থেকে সে পাটগুলো খুবই নিম্নমানের;অর্থাৎঅফসিজনে তাদের বাধ্য হয়ে কিনতে হয় পঁচা কিংবা আধাপঁচাপাট। ফলে সরকারী পাটকলগুলো থেকে প্রস্তুতকৃত পণ্য ভালো মানের হয় না। অনেক পণ্যদ্রব্য এতটাই নিম্নমানের যে ফ্রিতে দিলেও শ্রমিকরা নিজেরাই সেগুলো নিতে অপ্রস্তুত।
এবার ভারতের কথায় আসি। যেহেতু বর্তমান সরকার অন্যায্য উপায়ে ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায় ক্ষমতায় রয়েছে; তাই ভারত যা বলছে একরকম বাধ্য হয়ে সরকারের তা শোনা লাগছে। আমাদের দেশের সবথেকে ভালো মানের পাট ভারতে রপ্তানি করে দেওয়া হচ্ছে।ভারতকে কম টাকা দরে পাট মৌসুমে পাট ক্রয় করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের রাজনৈতিকপলিসি হচ্ছে বাংলাদেশের পাটের বাজার দখল করা, বর্তমান সরকার সেখানে বাঁধাদেওয়াতো দূরের কথা বরং এ ব্যাপারে ভারতকে তীব্র সহায়তা করছে।ঘটনাটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বিষয়টি বোঝার জন্যপিছনে তাকানো দরকার। ১৯৯৪ সালে সহায়তার নামে বিশ্বব্যাংক আদমজীকে ডাউন সাইজ করার কাজ শুরু করে অর্থাৎ আদমজীর তাঁতসংখ্যা ৩২৫০ থেকে কমিয়ে ১৫০০ করা হয়। বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার দেবার প্রতুশ্রুতি দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক আমাদেরকে দেয় মাত্র ৫ কোটি ডলার। একই সময়ে ইউএনডিপি (জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল) থেকে ভারতকে দেওয়া হয় ২৫ কোটি ডলার। ২০০২ সাল নাগাদ বন্ধ হয় বিশ্বের বৃহত্তম আদমজী পাটকল। বাংলাদেশের আদমজী পাটকল বন্ধেরআটদিন পর ভারতীয় পাটশিল্প আধুনিকীকরণের নতুন যাত্রা শুরু হয়। এদিন থেকে নতুনভাবে শুরু হয় তাদের পাটকলগুলোর মেশিনপত্র নবায়নের, অতীতের সমগ্র বকেয়া ঋণ মওকুফ করা এবং সেইসাথে নবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রদানের।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে পাটের কাঁচামাল ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে শ্রমিক-কর্মচারীরা কোনোভাবেই জড়িত নয়। সেখানে সরকারতারপুষ্ট কিছু লোকদের পুষেরেখেছে। কাঁচামাল লেনদেনের সাথে জড়িত রয়েছে এইসব নিয়োগপ্রাপ্ত লোক থেকে শুরু করে উপরের শ্রেণীর হম্বাতম্বা ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগপুষ্ট লোকেরা। সেখানে দুর্নীতির সব রকমের আয়োজন খোলা থাকে। অর্থাৎ সীমাহীন দুর্নীতি (সমুদ্রচুরি) ও অব্যবস্থাপনায় এ খাতটা সর্বদা পরিপূর্ণ।
সরকারী এসকল পাটকলের কাঁচামাল শহরের নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে কেনা হলেও খাতাকলমে লেখা হয় ভিন্ন কথা। যেমন, খুলনাতে শহরের নিকটবর্তী দৌলতপুর থেকে পাটের কাঁচামাল ক্রয় করলেও খাতাকলমে লেখা হয় সিরাজগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, রংপুর এমনসব দূরবর্তী অঞ্চল থেকে পাটের কাঁচামাল ক্রয় করা হয়েছে। ফলে মোটা অংকের একটি টাকা যাতায়তের খরচ দেখিয়ে সরকারপুষ্ট সেসব নিয়োগপ্রাপ্ত লোকেরা দু'দিনেই লক্ষ লক্ষ টাকার ঢিবিতে পৌঁছে। এটা একটা অসৎ উপায় মাত্র। এরকম ডজন ডজন অসৎ ব্যাপার সেখানে রয়েছে। যাইহোক, তারপর তারা নিজেরা এক একটা প্রাইভেট পাটকলের একক বা যৌথ মালিক হয়; ফলে তাদের কোটি কোটি টাকার পাহাড়ে পৌঁছতে আর খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়না। যাদের সকলের শহরে হালি হালি ফ্লাট বাড়ি—ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার রয়েছে। সবথেকে কম থাকা মানুষটিরও শহরে চারটি ফ্ল্যাটবাড়ি ও দুইটি গাড়ি রয়েছে। সারা দেশে এই একই অবস্থা বিদ্যমান। ফলে লোকসানের পর লোকসান হতে হতে পাটকলগুলো আজ অনিবার্য ধ্বংসের দিকে। এসব পাটকলগুলোর ট্রেড ইউনিয়ন নামে রয়েছে সরকারি মাস্তান বাহিনী। যেখানে সরকারি দলগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য শ্রমিক নেতার নামে সন্ত্রাসীদের প্রতিপালন করা হয়।
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত এসকল পাটকলগুলিতে প্রস্তুতকৃত অনেক পণ্যেই যেগুলোর মান অনেকাংশে ভালো সেগুলোতে মাঝেমধ্যে ভারতের সিল মারতে দেখা যায়। শ্রমিকরা সহসা কেউ এসব নিয়ে কথা বলার সাহস পায়না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার কারণে শ্রমিকদের অনেকের চাকরি থেকে বরখাস্থসহ নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে উৎপাদিত মানসম্মত পাটের কাঁচামাল ভারতে রপ্তানি হয়ে থাকে এবং বিদেশি ক্রেতারা এই পণ্যগুলো বাংলাদেশের কাছ থেকে নয়—ভারতের কাছ থেকে কিনে। এছাড়া ভারত পাট প্রসেসিং করে আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে আর আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে পাট প্রসেসিং করা হয় মান্ধারতার আমলের সেইসব মেশিনে। নতুন মেশিন আমদানি করতে সরকারের বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা নেই। বরং সরকার দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে আপন কলাবাগান সাফ করে দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও ভারতের কূটকৌশলের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে।
সরকার থেকে বলা হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমতার ভিত্তিতে পাটকলগুলো চালু রাখা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবটা ভিন্ন কথা বলে। অতীতে যেমনটা হয়েছে। কিছু পাটকল চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত যখন তরতর করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশের মধ্যে সরকারপুষ্ট কিছু লোকের হাতে পানির দামে পাটকলের জমি ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি চালানোর নামে তারা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়েছে, তারপর ঋণ খেলাপি হয়েছে, অতঃপর নামওয়ালা ধনীক শ্রেণীর কাতারে মিশেছে।
যখন কিনা সারাবিশ্বপলিথিন ও প্লাস্টিকদ্রব্য পরিহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে—পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা হু হু করে বাড়ছে; তখন বাংলাদেশের সরকার নিজের দেশের পাটশিল্পকে ধ্বংস করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলো। পাটের মধ্যে লুকিয়ে থাকাভূতগুলোকে না তাড়িয়ে শুধুমাত্র দেশের লুটতরাজ শ্রেণীর কিছু লোক ও অন্য একটি দেশের স্বার্থে নিজের শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থের তোয়াক্কা না করে আপন দেশমাতার বুকে চাবুক মারলো সরকার। দেশের শ্রমিক—জনগণ কি এ জুলুমমেনে নিবে?
0 Comments