বিড়ালের দৃষ্টি
তাইবা তুলবি
বর্ষা এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এই সময়ে প্রায়ই কোনো কারণ না জানিয়ে বৃষ্টি হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। কাল বিকেলের বৃষ্টির জল এখনো জমে আছে ইটের ফাঁকে ফাঁকে। আজ সূর্য কিরণে তার ভাসমান মুখ দেখা যাচ্ছে ইটের জমা জলে, কালো মুখে বসানো হলদে দুটো চোখ, সে একটি বিড়াল।
কিছুক্ষণ চেহারাটা ঠাহর করে দেখে, ততক্ষণাৎ মুখ তুলে ডানে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো সে।
তারপর কিছুক্ষণ কি ভেবে থমকে, আবার তার নিজের মতোন হাঁটছে, বুক উঁচিয়ে। ঠিক যেমনটা তার পূর্বপুরুষ হেঁটে এসেছে।
সুন্দরী মেয়েরা এভাবে হাঁটলে তখন তাকে বলে ক্যাট ওয়াক।
এটি হলো বুক উঁচিয়ে, কাঁধ নাড়িয়ে, একই তালে পা নাঁচিয়ে, নিজেকে তুলে ধরার এক কঠোর প্রচেষ্টা। আলোয় সাজানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে, মেয়েদের এই ক্যাট ওয়াক দেখতে যায় শহুরে বড় বড় লোকেরা। কিন্তু সে তো বিড়াল, বিড়ালকে হাঁটতে হয়, জমা জলের নোংরা দেয়ালে। এভাবে এই দেয়াল ঘেঁষা ঘরের আশেপাশে হাঁটা তার প্রতিদিনকার কাজ। আজও সে তাই করছে,
প্রতিদিনের মতন সময়ের অপেক্ষা।
কোনো অস্থির ভাবনা নেই। কোনো তাড়া নেই। এতো ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষাটা অবিশ্বাস্য নয়, কারণ এখানে আর কোথাও খাবারের তেমন সুবিধা হয় না তার।
একতলা এই বাড়িতে বিয়ে করে বসে থাকা সংসারখানা সে পাকঘরে দেখতে পাবে। এটাই তার মূল ও একমাত্র উদ্দেশ্য।পাকঘরহীন তো আর সংসার হয় না। খাবার বানানো মানুষের সংসারের একটা অংশ।
এ জানালায় যে সংসার দেখা যায়, সেটা আশিক আর সারাহ্- র। তারা দুজনেই চাকরি করে। সারাদিন বাসাটা শূণ্য পড়ে থাকে। এদিক ওদিকে হেঁটেই সারাদিনটা তার পার হয়ে যায়।দিনের বেলার বৃষ্টিতে ঘরটাতে আশ্রয় নিয়ে, ক্ষণিক ঘুমিয়েও নেয়া যায়। তারা আসলে তবেই খাবার জুটবে, ভাগ্যের ব্যাপার হলো, মাছ সপ্তাহে তিনদিন অবশ্যই তাদের মেনুতে থাকে।
তাদের রুটিন তার একদম মুখস্থ হয়ে গেছে। আশিকের আগেই সারাহ্ ঘরে ফিরে।
মাপকাঠি স্বরুপ ধরলে, বিকেল নামার ঠিক পর হতে, সন্ধ্যার সূর্য ডুবতে যা সময় লাগে,ঠিক ততটা সময় আগে সারাহ্ ঘরে ফিরবে।
সারাহ্ এসে নিজে স্নান করবে, তারপর খাবার বানাবে, শোবে। তারপর আশিক আসবে বিশ্রাম নিবে, বই পড়বে, ততক্ষণে সারাহ্ চা বানাবে। দেয়ালটা রান্নাঘরের জানালা হয়ে বেডরুমসহ একেবারে সামনের দরজা অবদি গেছে। বেডরুমের দিকের দেয়ালে কালো গাছের ঝোপে বসে, সবটাই সে দেখতে পায়। তাছাড়া একটা বড় গাছ এমনভাবে এদিকটায় নুয়ে আছে, এদিকে অপেক্ষা করতে তার বেশ সুবিধায় হয়। এদিক থেকে প্রায়ই সারাহ্-র মাছ রান্নার ঘ্রাণ পাওয়া যায় দারুণ।
কিন্তু তখন তো সে কিছুই খেতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের পরিপূর্ণ নিদ্রা আসবে ক্লান্ত শরীরে। খেয়ে পড়তে না পড়তেই তাদের হুঁশ থাকে না। তখন গিয়ে মনমত খেয়ে গভীর ঘুম দেয়া যায় পাশের ছাদের উপরে রাখা বড় পাইপের একটাতে। বেশ আরামেই ঘুম হয় জায়গাটায়।
সকালে সে খেতে পারতো, কিন্তু উচ্ছিষ্ট আধ খাওয়া খাবারগুলো সকালেই ফেলে দিয়ে যায় সারাহ্, তাও ময়লার গাড়িতে। অনেকবারই এরকম হয়েছে,তখন তো না খেয়ে দাঁত বেরিয়ে গেছিলো তার। সকলে বিড়াল নিয়ে এতোটা সচেতন যে, কারও কারও বাড়ির জানালা অবদি বন্ধ থাকে। এ পরিবারটা সত্যিই ভিন্ন। সারাহ্-ও বাসায় থাকে না। বাকিঘরগুলোতে মহিলাদের সহজে বের হতে দেখা যায় না। তার বড় অসুবিধা হয়ে যায় সেখানে হাঁটা চলায়। কোলাহল তার একদমই পছন্দ নয়।
আজও প্রতিদিনকার মতোন সারাহ্ সন্ধ্যার পরপরই এসেছে।আশিকও সঠিক সময়ে ঘরে ফিরেছে, সারাহ্ চা করছে, আশিক রেস্ট নিচ্ছে। একদম নিত্যদিনকার রুটিনই চলছিলো,
কিন্তু কেনো যেন শেষমেশ ব্যপারটা হয়ে গেলো ঘরের দরজায় এসে হোঁচট খাওয়ার মতন।
কারণ আজ আচমকা জ্বরের ঝড় উঠলো আশিকের গায়ে।সে ঘুমোতে পারছে না। শরীর মোচড়ে পোকার মতোন গুটে গেছে সে। সারাহ্ও ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কখনো কাথা চাপাচ্ছে, কখনো মুখে দিচ্ছে কাঁচের সরু নল, আর কখনো ওষুধ খুঁজাখুঁজিতে ঘরময় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তার কোমল শরীরে হয়তো এখনো ক্লান্তি আসে নি।
আকাশে মেঘ জমে আসছে ক্রমশ, মাঝেমাঝে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ঢুলু ঘুম ঘুম পরিবেশ অথচ তাদের ঘুম নেই।
তাও, সঠিক সময়ের অপেক্ষায় জানালার দিকে বসে রইলো তার অপেক্ষারত চোখ। আজ সারাহ্ মাছ করেছিলো খাবারে।
মাছ ফেলে যাওয়া তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অনেক সময় পরও সারাহ্কে বারবার পাকঘরে আসা যাওয়া করতে দেখা যাচ্ছে জলপট্টি, ঔষধ, জল ইত্যাদি নিয়ে একটা ব্যস্ততা। পাকঘর সত্যিই সংসারের জন্য অতি জরুরি অংশ। এই গুরুত্বটা বুঝতে বুঝতে, তার নজরে পড়লো, সারাহ্-র মুখে পড়া বেদনার ছাপ, তাছাড়া একটু ক্লান্তিও দেখা যাচ্ছে, বোধ হলো এখন সে ঘুমাবে। ঘরের ডিম লাইট জ্বলে উঠলো। মৃদু একটা আলো ছড়িয়ে গেছে রুমে। সে এ বিষয়ে অবগত না হলেও, এটা সত্যি যে সে অনেক রংই দেখতে পায় না।
দিনের অতি উজ্জ্বল আলোয়, বিড়ালের চোখ পৃথিবীকে ফ্যাকাশে রঙ্গে দেখে। কিন্তু রাতের মৃদু আলোয় বিড়ালের চোখ সে সবটা দেখতে পায়, যা মানুষের চোখের নাগালের বাইরে।
মানুষের চোখের দৃষ্টি শক্তি ভিন্ন কিনা বা ঠিক কেমন, সে বিষয়ে তার কোনো ধারনা না থাকলেও মানুষের কানে শোনার ক্ষমতা অবশ্যই কম এবং এ বিষয়ে সে সন্দেহ করতে পারে না। কারণ বেশ জোরে জোরে কথা বলে থাকে তারা। আর অতি শব্দ তার কাছে সর্বদায় বিরক্তিকর।
এই কালো রাতে, তার হলদে জ্বলজ্বলে চোখদুটো জানালা থেকে ক্ষনিকের জন্যও নড়ছে না। এই মৃদু আলোয় তাদের ঘর যেন আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারা অবশ্যই জেগে। এখন পাকঘরের জানালায় লাফিয়ে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছেটার রুপ দেয়া যেতে পারতো। কিন্তু না, আরও একটু ধৈর্য্য তাকে ধরে রাখতেই হবে। এই ধৈর্য্যটা হারালে হয়তো পরের বার থেকে সারাহ্ খাবার তার নাগালের বাইরে রেখে দেবে। তখন তো তার আর কখনোই খাবার জুটবে না।
এভাবে, রাত একটা পেরিয়ে দুটো। বেডে আশিকের মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে গল্প শোনাচ্ছে সারাহ্। আশিক চুপচাপ। এই ঠান্ডা মৃদু পরিবেশেও, একটা উষ্ণ ভাব বের হচ্ছে তার শরীর হতে। সারাহ-র্ সে উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে। একটু পর পরই তার হাতে হাত রাখছে, কপালে হাত রাখছে।
আশিক সারাহ্-কে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু তার মুখে শব্দ বের হতে গিয়েও যেন ঠোঁটে এসে আঁটকে যাচ্ছে। যেই শব্দ খুব কষ্টে অল্প বের হচ্ছে, তা শুধু হিস হিস শব্দ। কিছুই বুঝতে পারছে না সারাহ্।
কিন্তু সে তো বিড়াল। কান অল্প খাঁড়া করে স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে, আশিকের হিসহিসানি।
সারাহ্ না শুনেই বলল, "স..ব ঠিক হয়ে যাবে।"
তারপর কিছুক্ষন তার দিকে চেয়ে থাকলো,
"কাল চাকরি যাবো না, তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো, ভালো হয়ে যাও প্রিয়।"
আর আশিক কথাটা বলার জন্য এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু এবার সারাহ্ তার আংটি পড়া আঙ্গুলটা দিয়ে আশিকের ঠোঁট চেপে ধরেছে । নতুন বিবাহিতরা শুরুতে অবশ্য তা লাগিয়ে রাখে। সে তা দেখেছে বহুবার, বহু কিশোরি, মেয়ে, মহিলাদের হাতে।
"কিছু বলো না তুমি, খুব জ্বর তোমার। একটু অপেক্ষা, আর পনেরো মিনিট, জ্বর পড়ে যাবে।"
আশিক হিসহিস শব্দটুকুও আর করলো না।
আস্তে আস্তে মধ্যরাত নেমে এসেছে। কিন্তু তাদের চোখে এখনো ঘুম নামে নি। হালকা ফোটার মৃদু বৃষ্টি শুরু হয়েছে কালো আকাশে। এই ঘন গাছটার কারণে তেমন বৃষ্টি পড়তে পারছে না তার গায়ে। তার তীক্ষ্ণ চোখ এখনো অপেক্ষার কোনো কাঁটায় ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। মাছের লালসা একটু একটু করে তার ধৈর্য্য ক্ষমতা যাচাই করে চলছে। ক্ষাণিক কি ভেবে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ কবার কুচকে আবার সেই মৃদু আলোতে ডুব দিলো তার চোখ দুটো।
আশিকের দেহ ঘর্মাক্ত। হঠাৎ সারাহ্-র হাত চেপে ধরেছে সে।
তার জ্বর ছেড়ে গেছে। গলার জোর ফিরে এসেছে। সারাহ্কে এবার বলতে পেরেছে, এবং বেশ জোরেই "অনেক ভালোবাসি তোমায়।"
সারাহ্ তার কপালে একটা চুম্বন দিতেই খোলা চুল লেগে গেছে তার ঘর্মাক্ত মুখে।
আর ইতিমধ্যে আকাশের বদল শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎের এক একটা ঝলকানিতে সবটা দিনের মতোন আলো হয়ে যাচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দগুলো যেন আকাশের সমস্ত কিছুকে টেনে ছিঁড়ে নিচে নামিয়ে আনতে চাইছে। জানালার বাইরে একান্তে
বসে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর ঠেকেছে তার কাছে।
লোমশ শরীরে লুকিয়ে থাকা বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে এক একটা তীব্র বজ্রপাতে। পাতার আড়ালে নিজেকে আরও গুটিয়ে নিলো সে। এতো শব্দ তার ভালো লাগে না। ভয় করে।
সারাহ্ তার মুখ তুলে তাকালো, আশিকের ঘর্মাক্ত ভেজা মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে বলল, "তোমার জ্বর তো একদম পড়ে গেছে।"
"সারারাত খাটুনি গেছে। এসো আমরা ঘুমাবো।" বলে উঠলো আশিক। সারাহ্ জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিতে গিয়ে জানালার খোলা অংশ হতে একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলো তাদের দুজনকে ছুঁয়ে।
আর সে রাতে কোনো ক্লান্তি তাদের ছুঁতে পারে নি। তাদের ঘুমন্ত নিদ্রালু চারটা চোখ বুজেও যেন জেগে ছিলো সারারাত।আর অপেক্ষারত বিড়ালটির কোথায় যেন একটা বোধ হলো যে, আসলে সে তার অপেক্ষার উদ্দেশ্যটা হারিয়ে ফেলেছে।
সারাহ্-র নেশাময় চোখে একটা হাসি হাসি ভাব,
"এই বৃষ্টি, বাতাস, বিজলির হঠাৎ আলো, মনে হয়েছে যেন আমাদের প্রেমের একটা বিশাল সেলিব্রেশন করেছে।"
আশিক অল্প হেসে বলল, "হুম, বিষয়টা দারুণ।"
কথা বলতে বলতেই, মাত্র দু'মিনিটেই ঘুম ঢলে পড়েছে তাদের চোখে।
বিড়ালের সমস্ত লোম ভিজে চুপসে গেছে। পাতার আড়াল থেকে নিজেকে আরেকটু বার করে আবার ডানে বামে তাকালো সে।আবার কি কি ভেবে থেমে থাকলো কিছুক্ষণ।
পাখিদের ডাক পড়তে শুরু হয়েছে, ভোরের আলো ফুটে উঠতে আর বেশি দেরি নেই। বৃষ্টিও থেমে গেছে।
কেন যেন পাকঘরে যেতে তার আর মন চাইলো না। তার পূর্বপুরুষদের ধারা অক্ষুন্ন রেখে, বৈশিষ্ট্যময়ী বিশেষ ভঙ্গিতে সে দেয়াল ধরে বাঁ দিকে হাঁটা দিলো ধীরগতিতে।
1 Comments
♥
ReplyDelete