নির্মোক || অভিজিৎ চক্রবর্তী

 

নির্মোক 
অভিজিৎ চক্রবর্তী  

সকালে স্নান-খাওয়া সেরে রমিজুদ্দিন কারখানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। আজ সাত বছর সে কারখানাতে কাজ করছে। বাড়িতে সে একাই কর্মক্ষম ব্যক্তি।তার রোজগার বন্ধ মানেই তার সাথে আরও পাঁচটি অভুক্ত মুখ।বাড়িতে অসুস্থ মা,পঙ্গু ভাই,তার স্ত্রী আর দুটো পরীর মতো ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তাই কাজ'কে সে খোদা মানে,তার বড় উদাহরণ এই সাত বছরে সে অনুপস্থিত ছিলো মাত্র তিন দিন।
ধীর পায়ে সে কারখানার দিকে এগুতে থাকে।আজ-কাল তাকে একাই যেতে হয় কাজে,দেশে মহামারী চলছে।কারখানার বাবুকে সে বলতে শুনেছে করোনা নামে এক ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী লাখো প্রাণ।

কিছুদূর যেতেই সে দেখতে পায় আজ কারখানার বাইরে অনেক ভীড় জমেছে। রমিজুদ্দিন ভাবে এই সব রোজকার নাটক,শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা এইসব মহামারীর সময়'কে কাজে লাগিয়ে প্রায়ই জটলা পাকিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়ে কেটে পড়ে;সে এই সব ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
কারখানার গেটে পৌঁছেই বুঝতে পারে আজ পরিবেশ বেশ থমথমে, সাধারণ শ্রমিকদের মুখ ঘন মেঘের মতো কালচে হয়ে উঠেছে।কেউ সামাজিক দূরত্ব মানছে না,যেনো পারিবারিক ও আর্থিক নিরাপত্তা সকল কিছু গ্রাস করেছে।পাশের একজন এসে তাকে জানায় করোনার কারণে কারখানার অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে,তাই ছয় সিফটের বদলে আজ থেকে তিন সিফট চলবে। তাদের সিফটের সকলের চাকরী চলে গেছে। 
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে রমিজুদ্দিনের,তার জানা মতে সে কখনও কারও ক্ষতি করে নি। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য সে বড় বাবুর সাথে লোনের কথা আলাপ করবে ভেবেছিলো। শ্লথপায়ে কারখানা থেকে বেড়িয়ে আসে সে।
কারখানার পাশে উঁচু ঢিবিতে বসে আছে রমিজুদ্দিন, তৃষ্ণা ও ক্ষুধা তার সমস্ত শরীরে। চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে অসুস্থ মায়ের মুখ,পঙ্গু ভাইয়ের ঔষধের প্রেসক্রিপশান,অনাহারী স্ত্রী-সন্তানের মুখ।
পাশে বসে আছে তার পোষা কুকুর ভূতো।
হঠাৎ মোবাইল'টা বেজে উঠে তার,বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভব করে,আস্তে করে পকেট থেকে বের করে রিসিভ বাটনে চেপে মৃদু স্বরে বলে উঠে,'হ্যালো'
অপর প্রান্তে শুনতে পায় তার স্ত্রীর গলা,'বাড়ি আসার পথে চাল নিয়ে এসো।নাহলে আজও সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।' 
এসব কিছু শুনতে চায় না সে, ফোনটা ধীরে নামিয়ে রাখে। পকেটে হাত দিয়ে দেখে দশ টাকার একটা চকচকে নোটই অবশিষ্ট আছে।
সামনের দোকানে গিয়ে একটা পাউরুটি কিনে নেয় রমিজুদ্দিন,আস্তে আস্তে ঢিঁবির উপরে বসে চাবাতে থাকে। সহসা ভূতো তার হাত কামড়ে ধরে, সেও যেনো বহুদিন না খাওয়া;হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চায় অবশিষ্ট পাউরুটিটুকু।হাত থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরুতে থাকে। সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায় রমিজুদ্দিনের, দু হাতে গলা চেপে ধরে ভূতোর। কিছুক্ষণ ছাড়ানোর চেষ্টার পর ধীরে ধীরে নিথর হয়ে পড়ে ভূতোর শরীর,এদিকে রমিজুদ্দিনের গাল বেয়ে পড়তে থাকতে অশ্রু।
সহসাই উঠে দাঁড়ায় সে,জোর পায়ে হাঁটতে থাকে বাড়ির পথে।কাজ এখনও শেষ হয় নি,তাকে আজ আরও পাঁচটি প্রাণ'কে মুক্তি দিতে হবে.... 

Post a Comment

0 Comments